পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৫৭৬ রবীন্দ্র-রচনাবলী ইতিহাসের গতি অচল হইয়া পড়িত। তিনি একটি প্রবল স্রোতস্বিনীর মধ্যে দুটি-একটি নীেকা ভাসাইয়া দিয়া নদীর স্রোত এবং নীেকা উভয়কেই একসঙ্গে দেখাইতে চাহিয়াছেন । এইজন্য চিত্রে নীেকার আয়তন অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র হইয়াছে, তাহার প্রত্যেক সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম অংশ দৃষ্টিগােচর হইতেছে না। চিত্রকর যদি নীেকার ভিতরের ব্যাপারটাই বেশি করিয়া দেখাইতে চাহিতেন। তবে নদীর অধিকাংশই তাহার চিত্ৰপট হইতে বাদ পড়িত ৷ হইতে পারে কোনো কোনো অতিকৌতুহলী পাঠক ঐ নীেকার অভ্যন্তরভাগ দেখিবার জন্য অতিমাত্র ব্যগ্র, এবং সেইজন্য মনঃক্ষোভে লেখককে তাহারা নিন্দা করিবেন । কিন্তু সেরূপ বৃথা চপলতা পরিহার করিয়া দেখা কর্তব্য, লেখক গ্রন্থবিশেষে কী করিতে চাহিয়াছেন এবং তাঁহাতে কতদূর কৃতকার্য হইয়াছেন । পূর্ব হইতে একটা অমূলক প্রত্যাশা ফাদিয়া বসিয়া তাহা পূর্ণ হইল না বলিয়া লেখকের প্রতি দোষারোপ করা বিবেচনাসংগত নহে। গ্রন্থপােঠারম্ভে আমি নিজে এই অপরাধ করিবার উপক্ৰম করিয়াছিলাম বলিয়াই এ কথাটা বলিতে হইল । Ob Swo o ফুলজানি ফুলজানি । শ্ৰীশ্ৰীশচন্দ্র মজুমদার -প্ৰণীত শহরে বিচিত্র জটিল ঘটনা, লোকজনের গতিবিধি, গাড়িঘোড়া-কলকারখানায় সমস্ত মানুষ ছোটাে হইয়া যায় ; শহরে কে বঁচিল কে মরিল, কে খাইল কে না খাইল তাহার খবর কেহ রাখে না । সেখানে বড়েলাট-ছোটোলাটের কীর্তি, চীনে জাপানে লড়াই, অথবা একটা অসামান্য ঘটনা নহিলে সর্বসাধারণের কানেই উঠিতে পারে না । কিন্তু পল্লীগ্রামে ছোটােবড়ো সকল মানুষ এবং মনুষ্যজীবনের প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত পরিস্ফুট হইয়া উঠে ; এমন-কি, নদীনালা পুষ্করিণী মাঠঘাট পশুপক্ষী রৌদ্রবৃষ্টি সকালবিকাল সমস্তই বিশেষরূপে দৃষ্টি আকর্ষণ করে । সেখানকার লোকালয়ে সুখ-দুঃখের সামান্যতম লহরীলীলা পর্যন্ত গণনার বিষয় হয়, এবং প্রকৃতির মুখশ্ৰীর সমস্ত ছায়ালোকসম্পাত একটি ক্ষুদ্র দিগন্তসীমার মধ্যে মহৎ প্রাধান্য লাভ করে । উপন্যাসের মধ্যেও সেইরূপ শহর-পল্লীগ্রামের প্রভেদ আছে। কোনো উপন্যাসে অসাধারণ মানবপ্রকৃতি, জটিল ঘটনাবলী এবং প্রচণ্ড হৃদয়বৃত্তির সংঘর্ষ বৰ্ণিত হইয়া থাকে- সেখানে সাধারণ মনুষ্যের প্রাত্যহিক সুখদুঃখ অণু-আকারে দৃষ্টির অতীত হইয়া যায় ; আবার কোনো উপন্যাস উন্মত্ত সর্বগ্রাসী প্ৰলয়বেগ হইতে বহুদূরে ধূলিশূন্য নির্মল নীলাকাশতলে, শস্যপূর্ণ শ্যামল প্রান্তরপ্রান্তে ছায়াময় বিহঙ্গকৃজিত নিভৃত গ্রামের মধ্যে আপন রঙ্গভূমি স্থাপন করে, যেখানে মানবসাধারণের সকল কথাই কানে আসিয়া প্রবেশ করে এবং সকল সুখদুঃখই মমতা আকর্ষণ করিয়া আনে। শ্ৰীশবাবুর “ফুলজানি” এই শেষোক্ত শ্রেণীর উপন্যাস। ইহার স্বচ্ছতা, সরলতা, ইহার ঘটনার বিরলতাই ইহার প্রধান সৌন্দর্য। এবং পল্লীর বাগানের উপর প্রভাতের স্নিগ্ধ সূর্যকিরণ যেমন করিয়া পড়ে ; কোথাও-বা চিকন পাতার উপরে ঝিকবিক করিয়া উঠে, কোথাও-বা পাতার ছিদ্র বাহিয়া অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে চুমকি বসাইয়া দেয়, কোথাও-বাঁ জীৰ্ণ গোয়ালঘরের প্রাঙ্গণের মধ্যে পড়িয়া মলিনতাকে ভূষিত করিতে চেষ্টা করে, কোথাও-বা ঘনছায়াবেষ্টিত দীর্ঘিকাজলের একটিমাত্র প্রান্তে নিকষের উপর সোনার রেখা কযিয়া দেয়- তেমনি এই উপন্যাসের ইতস্তত যেখানে একটু অবকাশ পাইয়াছে সেইখানেই লেখকের একটি নির্মল স্নিগ্ধহাস্য সকৌতুকে প্রবেশ করিয়া সমস্ত লোকালয়।দৃশ্যটিকে উজ্জ্বলতায় অঙ্কিত করিয়াছে। ।