পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q 8 r রবীন্দ্র-রচনাবলী و উভয় দলেই তেমন লোক ঢের আছে । কিন্তু আধ্যাত্মিকতা যাহাদের প্রকৃতির সহজ ধর্ম, সংসার র্যাহাদিগকে তৃপ্ত ও বিক্ষিপ্ত করিতে পারে না, যে দিকেই স্থাপন করা কম্পাসের কাটার মতো যাহাদের মন এক অনির্বচনীয় চুম্বক-আকর্ষণ অনন্তের দিকে আপনি ফিরিয়া দাঁড়ায়, জগদীশ্বরকে বাদ দিলে যাহাদের নিকট আমাদের স্থিতিগতি চিন্তাচেষ্টা ক্রিয়াকর্ম একেবারেই নিরর্থক এবং সমস্ত জগদব্যাপার নিরবচ্ছিন্ন বিভীষিকা, র্যাহারা অন্তরাত্মার মধ্যে পরমাত্মার প্রত্যক্ষ আনন্দ উপভোগ করিয়াই বুঝিতে পারিয়াছেন যে, আনন্দাদ্ধোব খদ্বিমানি ভুতানি জায়ন্তে, আনন্দেন জাতানি জীবন্তি, আনন্দং প্ৰয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি, সাধনা তঁহাদের নিকট দুঃসাধ্য নহে এবং তঁাহারা আপনাকে ভুলইয়া এবং আপনার ঈশ্বরকে ভুলইয়া সংক্ষেপে কার্যোদ্ধার করিতে চাহেন না- কারণ, নিত্যসাধনাতেই তাঁহাদের সুখ, নিয়তপ্ৰয়াসেই তাঁহাদের । প্রকৃতির পরিতৃপ্তি । সেইরূপ কোনো স্বভাবভক্ত যখন মূর্তিপূজার মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন তখন তিনি আপনি অসামান্য প্রতিভাবলে মূর্তিকে অমূর্ত করিয়া দেখিতে পারেন ; তাহার প্রত্যক্ষবর্তী কোনাে সীমা তীহাকে অসীমের নিকট হইতে কড়িয়া রাখিতে পারে না ; তঁাহার চক্ষু যাহা দেখে তাহার মন তাহাকে বিদ্যুদবেগে ছাড়াইয়া চলিয়া যায় ; বাহিরের উপলক্ষ তাহার নিকট কেবল অভ্যাসক্রমে থাকে মাত্র, তাহাকে দূর করিবার কোনো প্রয়োজন হয় না ; বিশ্বসংসােরই তাহার নিকট রূপক, প্রতিমার তো কথাই নাই ; যে লোকের অক্ষরজ্ঞান আছে সে যেমন অক্ষরকে অক্ষর রূপে দেখে না, সে যেমন কাগজের উপর যখন “গ” এবং “ছ দেখে তখন ক্ষুদ্র গয়ে আকার ছ। দেখে না। কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনশ্চক্ষে শাখাপন্নবিত বৃক্ষ দেখিতে পায়, তেমনি তিনি সম্মুখে স্থাপিত বস্তুকে দেখিয়াও দেখিতে পান না, মুহুর্তমধ্যে অন্তঃকরণে সেই অমূর্ত আনন্দ উপলব্ধি করেন, যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ। এই ইহকাল অসামান্য প্রতিভার দ্বারাই সাধ। সে প্রতিভা চেতনার ছিল রামপ্রসাদ সেন্স আবার প্রকৃতিভেদে কোনো কোনো স্বভাবভক্ত লোক প্রচলিত মূর্তি দ্বারা ঈশ্বরের পূজাকে আত্মবিমাননা এবং পরমাত্মাবমাননা বলিয়া অভ্যাসবন্ধন ছেদন করিয়া আত্মার মধ্যে এবং বিশ্বের মধ্যে তাহার উপাসনা করেন। মহম্মদ এবং নানক তাহার দৃষ্টান্ত । কিন্তু আমাদের মধ্যে ভক্তির প্রতিভা খুব অল্প লোকেরই আছে। প্রত্যক্ষ সংসার-অরণ্য আমাদিগকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে ; মাঝে মাঝে তাহারই ডালপালার অবকাশপথে অধ্যাত্মরশ্মি দেবদূতের তর্জনীর মতো আমাদের অন্ধকারের একাংশ স্পর্শ করিয়া যায়। এখন, আমরা যদি মাঝে মাঝে সংসারের বনচ্ছায়াতলে কীটানুসন্ধান ছাড়িয়া দিয়া অনন্ত আকাশের মধ্যে মুক্তির আনন্দ ভোগ করিতে চাই তো কী করিব ? “যদি চাই। এ কথা বলিতে হইল। কারণ, পূর্বেই বলিয়াছি আমরা সকলে চাই না, ঈশ্বরকে উপলক্ষ করিয়া আর-কিছু চাই। কিন্তু যদি চাই তো কী করিব ? তবে, যাহাতে বাধা যাহাতে অন্ধকার তাহা সাবধানে এড়াইয়া যে দিকে আলোক আপনাকে প্ৰকাশ করে সেই পথ দিয়া পাখা মেলিয়া আকাশের দিকে উড়িতে হইবে । সে পথ কেবলমাত্র ইন্দ্ৰিয়ের পথ ধূলির পথ পৃথিবীর পথ নহে, তাহা পদচিহ্নহীন বায়ুর পথ আলোকের পথ আকাশের পথ । আমাদের পক্ষে সেই এক পথ । যাহারা মুক্তক্ষেত্রে বাস করেন তাহারা মাটিতে বসিয়াও আকাশের আলো পান, কিন্তু যাহারা জটিল ধ্ৰু পািলত হইয়া আছে তাহাদিগকে একেবারে পৃথিবীর দিক হইতে উড়িয়া বাহির হইয় श । তাহা না করিয়া আমরা যদি আমাদেরই প্রবৃত্তি আমাদেরই আকৃতি দিয়া দেবতা গড়ি তবে তাহার মধ্যে মুক্তি কোনখানে ? যদি তাহাকে স্নান করাই, খাওয়াই, মশারিতে শোয়াই, এমন-কি, তাহার জন্য নটী নিযুক্ত করিয়া রাখি তবে তাহার ফল কী হয় ? তবে নিজের প্রবৃত্তিকেই দেবতা করিয়া পূজা করা