পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

2N90 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী করা থাকে। কিন্তু সুরের কত প্ৰভেদ । তাঁহাদের প্রতি কত প্ৰেম, কত সৌভ্রাত্র। কত বারংবার করিয়া বলা হয় যে, যদিও মাতৃভূমি হইতে তাহারা বিচ্ছিন্ন হইয়া গেছে তথাপি এখনাে মাতার প্রতি তাঁহাদের অচলা ভক্তি আছে, তাহারা নাড়ীর টান ভুলিতে পারে নাই- অর্থাৎ সে স্থলে স্বার্থের সঙ্গে প্রেমের কথারও উল্লেখ করা আবশ্যক হয় । আর, হতভাগ্য ভারতবর্ষেরও কোথাও একটা হৃদয় আছে এবং সেই হৃদয়ের সঙ্গে কোথাও একটু যোগ থাকা আবশ্যক। সে কথার কোনো আভাসমােত্র থাকে না । ভারতবর্ষ কেবল হিসাবের খাতায় শ্রেণীবদ্ধ অঙ্কপাতের দ্বারায় নির্দিষ্ট । ইংলন্ডের প্র্যাকটিক্যাল লোকের কাছে ভারতবর্ষের কেবল মন-দরে সের-দরে, টাকার দরে, সিকার দরে, গৌরব | সংবাদপত্র এবং মাসিকপত্রের লেখকগণ ইংলন্ডকে কি কেবল এই শুষ্ক পাঠই অভ্যাস করাইবেন । ভারতবর্ষের সহিত যদি কেবল তাহার স্বার্থের সম্পর্কই দৃঢ় হয় তবে যে শ্যামাঙ্গিনী গাভীটি আজ দুধ দিতেছে কালে গোপকুলের অযথা বংশবৃদ্ধি ও ক্ষুধাবৃদ্ধি হইলে তাহার লেজটুকু এবং ক্ষুরটুকু পর্যন্ত তিরোহিত হইবার সম্ভাবনা । এই স্বার্থের চক্ষে দেখা হয় বলিয়াই তো ল্যাঙ্কাশিয়ার নিরুপায় ভারতবর্ষের তীতের উপর মাশুল বসাইয়াছে আর নিজের মাল বিনা মাশুলে চালান করিতেছে । আমাদের দেশটাও যে তেমনি । যেমন রৌদ্র তেমনি ধুলা । কেবলই পাখার বাতাস এবং বরফ-জল না খাইলে সাহেব বঁাচে না। আবার দুর্ভাগ্যক্রমে পাখার কুলিটিও রুগণ প্লীহা লইয়া ঘুমাইয়া পড়ে, এবং বরফ সর্বত্র সুলভ নহে। ভারতবর্ষ ইংরাজের পক্ষে রোগশোেক স্বজনবিচ্ছেদ এবং নির্বাসনের দেশ, সুতরাং খুব মোটা মাহিনায় সেটা পােষাইয়া লইতে হয়। আবার পােড়া এক্সচেঞ্জ তাহাতেও বাদ সাধিতে চাহে ! স্বাৰ্থসিদ্ধি ছাড়া ভারতবর্ষ ইংরেজকে কী দিতে পারে । হায় হতভাগিনী ইন্ডিয়া, তোমাকে তোমার স্বামীর পছন্দ হইল না, তুমি তাহাকে প্রেমের বন্ধনে বাধিতে পারিলে না। এখন দেখাে, যােহাতে তাহার সেবার ত্রুটি না হয়। তাহাকে অশ্রান্ত যত্নে বাতাস করো, খসখসের পর্দা টাঙাইয়া জল সেচন করো, যাহাতে দুই দণ্ড তোমার ঘরে সে সুস্থির হইয়া বসিতে পারে। খোলো, তোমার সিন্ধুকটা খোলো, তোমার গহনাগুলো বিক্রয় করো, উদর পূর্ণ করিয়া আহার এবং পকেট পূর্ণ করিয়া দক্ষিণা দাও । তবু সে মিষ্ট কথা বলিবে না, তবু মুখ ভার করিয়া থাকিবে, তবু তোমার বাপের বাড়ির নিন্দা করিবে । আজকাল তুমি লজ্জার মাথা খাইয়া মান-অভিমান করিতে আরম্ভ করিয়াছ, ঝংকার-সহকারে দু-কথা পােচ-কথা শুনাইয়া দিতেছ। কাজ নাই বকবকি করিয়া ; যাহাতে তোমার বিদেশী স্বামী সন্তোষে থাকে, আরামে থাকে, একমনে তাহাই সাধন করে । তোমার হাতের লোহা অক্ষয় হউক । ইংরাজ রাজকবি টেনিসন মৃত্যুর পূর্বে র্তাহার সর্বশেষ গ্রন্থে সৌভাগ্যক্রমে ভারতবর্ষকে কিঞ্চিৎ স্মরণ করিয়াছেন । কবিবর উক্ত গ্রন্থে আকবরের স্বপ্ন - নামক একটি কবিতা প্ৰকাশ করিয়াছেন । আকবর তাহার প্রিয়সুহৃৎ। আবুল ফজলের নিকট রাত্রের স্বপ্নবর্ণন উপলক্ষে তাহার ধর্মের আদর্শ ও জীবনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করিতেছেন। তিনি ভারতবর্ষের ভিন্ন ধর্মের মধ্যে যে ঐক্য এবং ভিন্ন জাতির মধ্যে যে প্রেম ও শান্তি -স্থাপনার চেষ্টা করিয়াছেন, স্বপ্নে দেখিয়াছেন, তাহার পরবর্তীগণ সে চেষ্টা বিপর্যন্ত করিয়া দিয়াছে এবং অবশেষে সূর্যাস্তের দিক হইতে একদল বিদেশী আসিয়া তাহার সেই ভূমিসাৎ মন্দিরকে একটি-একটি প্রস্তর গাথিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়া তুলিয়াছে ; এবং সেই মন্দিরে সত্য এবং শান্তি, প্রেম এবং ন্যায়পরতা পুনরায় আপন সিংহাসন স্থাপন করিয়াছে। কবির এই স্বপ্ন সফল হউক প্রার্থনা করি। আজ পর্যন্ত এই মন্দিরের প্রস্তরগুলি গ্রথিত হইয়াছে ; বল পরিশ্রম ও নৈপুণ্যের দ্বারা যাহা হইতে পারে তাহার কোনো ত্রুটি হয় নাই ; কিন্তু এখনো এমন্দিরে সকল দেবতার অধিদেবতা প্রেমের প্রতিষ্ঠা হয় নাই । প্ৰেম-পদার্থটি ভাবাত্মক, অভাবাত্মক নহে। আকবর সকল ধর্মের বিরোধভঞ্জন করিয়া যে-একটি প্রেমের ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা করিয়াছিলেন তাহা ভাবাত্মক । তিনি নিজের হৃদয়-মধ্যে একটি ঐক্যের