পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V88 ・ রবীন্দ্র-রচনাবলী সত্যটুকুও প্রকাশ করিয়া বলা উচিত যে, উপযুপরি এই সকল ঘটনায় দেশের লোকের চিত্ত নিরতিশয় ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিতেছে। সাধারণ লোকে আইনের এবং প্রমাণের সূক্ষ্মবিচার করিতে পারে না। ভারতবষীয়কে হত্যা করিয়া কোনো ইংরাজেরই প্ৰাণদণ্ড হয় না, এই তথ্যটি বারংবার এবং অল্পকালের মধ্যে ঘন ঘন লক্ষ্য করিয়া তাহাদের মনে ইংরেজের অপক্ষপাত ন্যায়পরতা সম্বন্ধে সুতীব্ৰ সন্দেহের উদয় হয় । সাধারণ লোকের মুঢ়তার কেন দোষ দিই। গবর্মেন্ট অনুরূপ স্থলে কী করেন। যদি তাহারা দেখেন কোনো ডেপুটি-ম্যাজিষ্ট্রেট অধিকাংশসংখ্যক আসামিকে খালাস দিতেছেন তখন তাহারা এমন বিবেচনা করেন না যে, সম্ভবত উক্ত ডেপুটি-ম্যাজিষ্ট্রেট অন্য ম্যাজিষ্ট্রেট অপেক্ষা অধিকতর ন্যায়পর, এবং তিনি সাক্ষ্যের সত্যমিথ্যা সম্পূর্ণ নিঃসংশয় সূক্ষ্ম রূপে নির্ণয় না করিয়া আসামিকে দণ্ড দিতে কুষ্ঠিত, অতএব এই সচেতন ধর্মবুদ্ধি এবং সতর্ক ন্যায়পরতার জন্য সত্বর তাঁহার পদবৃদ্ধি করিয়া দেওয়া কর্তব্য ; অথবা যদি দেখিতে পান যে, কোনো পুলিশ-কর্মচারীর এলাকায় অপরাধের সংখ্যার তুলনায় অল্পসংখ্যক অপরাধী ধরা পড়িতেছে অথবা চালান আসামি বহুলসংখ্যায়। খালাস পাইতেছে তখন তাহারা এমন তর্ক করেন না যে, সম্ভবত এই পুলিশ-কর্মচারী অন্য পুলিশ-কর্মচারী অপেক্ষা সৎপ্রকৃতির- ইনি সাধু লোককে চাের বলিয়া চালান দেন না এবং মিথ্যা সাক্ষ্য স্বহস্তে সৃজন করিয়া অভিযোগের ছিদ্ৰসকল সংশোধন করিয়া লন না, অতএব পুরস্কারস্বরূপে অচিরাৎ ইহার গ্ৰেড বৃদ্ধি করিয়া দেওয়া কর্তব্য । আমরা যে দুই আনুমানিক দৃষ্টাস্তের উল্লেখ করিলাম উভয়তই সম্ভবপরতা ন্যায় ও ধর্মের দিকেই অধিক । কিন্তু কাহারও অবিদিত নাই, গবর্মেন্টের হস্তে উক্তবিধ হতভাগ্য সাধুদিগের সম্মান এবং উন্নতি লাভ হয় না। জনসাধারণও গবর্মেন্টের অপেক্ষা অধিক সূক্ষ্মবুদ্ধি নহে, সেও খুব মোটামুটি রকমের বিচার করে । সে বলে, আমি অত আইনকানুন সাক্ষীসাবুদ বুঝি না, কিন্তু ভারতবর্ষীয়কে হত্যা করিয়া একটা ইংরাজও উপযুক্ত দণ্ডাৰ্ছ হয় না। এ কেমন কথা । বারংবার আঘাতে প্ৰজাসাধারণের হৃদয়ে যদি একটা সাংঘাতিক ক্ষত উৎপন্ন হইতে থাকে। তবে তাহা গোপনে আচ্ছন্ন করিয়া রাখা রাজভক্তি নহে। তাই ‘ব্যাবু-অভিহিত অস্মাৎপক্ষীয়েরা এ-সকল কথা প্ৰকাশ করিয়া বলাই কর্তব্য জ্ঞান করে । আমরা ভারতরাজ্য-পরিচালক বাস্পযন্ত্রের ‘বয়লার স্থিত তাপমান মাত্র- আমাদের নিজের কোনো শক্তি নাই, ছোটাে বড়ো বিচিত্র লীেহচক্র-চালনার কোনো ক্ষমতাই রাখি না, কেবল বৈজ্ঞানিক নিগুঢ় নিয়মানুসারে সময়ে সময়ে আমাদের চঞ্চল পারদবিন্দু হঠাৎ উপরের দিকে চড়িয়া যায়। কিন্তু এঞ্জিনিয়ার-সাহেবের তাহাতে রাগ করা কর্তব্য নহে। তিনি একটি ঘুষি মারিলেই এই ক্ষুদ্র ক্ষণভঙ্গুর পদার্থটি ভাঙিয়া তাহার সমস্ত পারদটুিকু নাস্তি-নাভূত হইয়া যাইতে পারে- কিন্তু বয়লার-গত উত্তাপের পরিমাণ নিৰ্ণয় করা যন্ত্র-চালনকার্যের একটা প্ৰধান অঙ্গ । ইংরাজ অনেক সময় বিপরীত উগ্ৰ মূর্তি ধারণ করিয়া বলে, প্রজাসাধারণের নাম করিয়া আত্মপরিচয় দিতেছ তোমরা কে । তোমরা তো আমাদেরই স্কুলের গুটিকয়েক বাক্যবিশারদ ইংরাজিনবিশ । প্ৰভু, আমরা কেহই নাহি। কিন্তু তোমাদের বিদ্রুপ বিরক্তি এবং ক্ৰোধদহনের দ্বারা অনুমান করিতেছি, তোমরা আমাদিগকে নিতান্তই সামান্য বলিয়া জ্ঞান কর না, এবং সামান্য জ্ঞান করা কর্তব্যও নহে । সংখ্যায় সামান্য হইলেও এই বিচ্ছিন্নসমাজ ভারতবর্ষে কেবল শিক্ষিতসম্প্রদায়ের মধ্যেই শিক্ষা এবং হৃদয়ের ঐক্য আছে, এবং এই শিক্ষিতসম্প্রদায়ই ভারতবষীয় হৃদয়বেদনা স্পষ্ট করিয়া প্রকাশ এবং নানা উপায়ে সঞ্চারিত করিয়া দিতে পারে। এই শিক্ষিতসাধারণের অন্তরে কখন কিরাপ আঘাত-অভিঘাত লাগিতেছে তাহা মনোযোগসহকারে আলোচনা করা গবমেন্টের রাজনীতির একটা প্রধান অঙ্গ হওয়া উচিত। লক্ষণে যতদূর প্রকাশ পায়, গবর্মেন্টেরও তাঁহাতে সম্পূৰ্ণ ঔদাসীন্য নাই। আমরা আলোচিত ব্যাপারে দুই কারণে আঘাত পাই। প্রথমত, একটা অত্যাচারের কথা শুনিলেই তাহার উপযুক্ত দণ্ডবিধানের প্রত্যাশা করিয়া হৃদয় ব্যগ্ৰ হইয়া থাকে। যেজন্যই হউক, দোষী অব্যাহতি পাইলে অন্তর ক্ষুব্ধ হয় । দ্বিতীয়ত, এই সকল ঘটনায় আমরা আমাদের জাতীয় অসম্মান তীব্ররূপে