পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজা প্ৰজা V&V মাহুত বসিয়া তাহাকে মাঝে মাঝে অঙ্কুশ দিয়া মারে, হাতির পক্ষে তাহা সুখকর নহে। কিন্তু মাহুতের বদলে যদি আর-একটা গোটা হাতিকে সর্বদা বহন করিতে হইত। তবে বাহকটি অঙ্কুশের অভাবকেই আপনার একমাত্র সৌভাগ্য বলিয়া জ্ঞান করিত না । একটিমাত্র দেবতার পূজার থালায় যদি ফুল সাজাইয়া দেওয়া যায়। তবে তাহা দেখিতে কৃপাকার হইতে পারে, এবং যে ব্যক্তি ফুল আহরণ করিয়াছে তাহার পরিশ্রমটাও হয়তো অত্যন্ত প্ৰত্যক্ষরূপে দেখা যায়। কিন্তু তেত্ৰিশ কোটি দেবতাকে একটা করিয়া পাপড়িও যদি দেওয়া যায়। তবে তাহা চোখে দেখিতে যতই সামান্য হউক-না কেন, তলে তলে ব্যাপারখানা বড়ো কম হয় না। তবে কিনা, এই একটা একটা করিয়া পাপড়ির হিসাব এক জায়গায় সংগ্ৰহ করা কঠিন বলিয়া নিজের অদৃষ্টকে ছাড়া আর কাহাকেও দায়ী করার কথা মনেও উদয় হয় না । । কিন্তু, এখানে কাহাকেও বিশেষরূপে দায়ী করিবার কথা হইতেছে না । মোগলের চেয়ে ইংরেজ ভালো কি মন্দ তাহার বিচার করিয়া বিশেষ কোনো লাভ নাই। তবে কিনা, অবস্থাটা জানা চাই, তাহা হইলে অনেক বৃথা আশা ও বিফল চেষ্টার হাত হইতে রক্ষা পাওয়া যায়। সেও একটা লাভ । মনে করো, এই-যে আমরা আক্ষেপ করিয়া মরিতেছি দেশের বড়ো বড়ো চাকরি প্রায় ইংরেজের ভাগ্যে পড়িতেছে, ইহার প্রতিকারটা কোনখানে। আমরা মনে করিতেছি, বিলাতে গিয়া যদি দ্বারে দ্বারে দুঃখ নিবেদন করিয়া ফিরি। তবে একটা সদগতি হইতে পারে। কিন্তু এ কথা মনে রাখিতে হইবে, যাহার বিরুদ্ধে নালিশ আমরা তাহার কাছেই নালিশ করিতে যাইতেছি । পাইয়াছি— এখন যে তাহা আমাদের আশার অতীত হইয়াছে ইহার কারণ কী। অন্য গৃঢ় বা প্রকাশ্য কারণ ছাড়িয়া দাও, একটা মোটা কারণ আছে সে তো স্পষ্টই দেখিতেছি । ইংলন্ড সমস্ত ইংরেজকে অন্ন দিতে পারে না, ভারতবর্ষে তাহাদের জন্য অন্নসত্র খোলা থাকা আবশ্যক । একটি জাতির অন্নের ভার অনেকটা পরিমাণে আমাদের স্কন্ধে পড়িয়াছে ; সেই অন্ন নানারকম আকারে নানারকম পাত্রে জোগাইতে হইতেছে । যদি সপ্তম এডোয়ার্ড যথার্থই আমাদের দিল্লির সিংহাসনে রাজা হইয়া বসিতেন তবে তাহাকে গিয়া বলিতে পারিতাম যে, হুজুর, অন্নোর যদি বড়ো বড়ো গ্রাস সমস্তই বিদেশী লোকের পাতে পড়ে তবে তোমার রাজ্য টেকে কী করিয়া । তখন সম্রাটও বলিতেন, তাই তো, আমার সাম্রাজ্য হইতে আমার ভোগের জন্য যাহা গ্ৰহণ করি । তাহা শোভা পায়, কিন্তু তাই বলিয়া বারো ভূতে মিলিয়া পাত পাড়িয়া বসিলে চলিবে কেন । তখন আমার রাজ্য বলিয়া তাহার দরদ বোধ হইত, এবং অন্যের লুব্ধ হস্ত ঠেকাইয়া রাখিতেন । কিন্তু আজ প্ৰত্যেক ইংরেজই ভারতবর্ষকে ‘আমার রাজ্য’ বলিয়া জানে । এ রাজ্যে তাহদের ভোগের খৰ্বতা ঘটিতে গেলেই তাহারা সকলে মিলিয়া এমনি কলরব তুলিবে যে, তাহাদের স্বদেশীয় কোনো আইনকর্তা এ সম্বন্ধে কোনো বদল করিতে পরিবেই না । এই আমাদের প্রকাণ্ড বহুসহস্ৰমুখবিশিষ্ট রাজার মুখের গ্রাসে ভাগ বসাইবার জন্য তাহারই কাছে দরবারে যাওয়া নিস্ফল, এ কথা একটু ভাবিয়া দেখিলেই বুঝা যায়। মোট কথা- একটা আস্ত জাত নিজের দেশে বাস করিয়া অন্য দেশকে শাসন করিতেছে, ইতিপূর্বে এমন ঘটনা ইতিহাসে ঘটে নাই। অত্যন্ত ভালো রাজা হইলেও এরকম অবস্থায় রাজার বোঝা বহন করা দেশের পক্ষে বড়ো কঠিন। মুখ্যত অন্য দেশের এবং গীেণত আপনার স্বাৰ্থ যে দেশকে একসঙ্গে সামলাইতে হয় তাহার অবস্থা বড়োই শোচনীয়। যে দেশের ভারকেন্দ্ৰ নিজের এতটা বাহিরে পড়িয়াছে সে মাথা তুলিবে কী করিয়া। নাহয় চুরি ডাকাতি বন্ধ হইল, নাহয় আদালতে অত্যন্ত সূক্ষ্ম সুবিচারই ঘটিয়া থাকে, কিন্তু বোঝা নামাইব কোথায় । অতএব কনগ্রেসের যদি কোনো সংগত প্রার্থনা থাকে। তবে তাহা এই যে, সম্রাট এডোয়ার্ডের পুত্ৰই