পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

38 329 r VS এইপ্ৰকার দুশ্চেষ্টা অনিবাৰ্য ব্যর্থতার মধ্যে লইয়া যাইবেই, তথাপি ইহাকে আমরা পরিহাস করিতে পারিব না। ইহার মধ্যে মানবপ্রকৃতির যে পরমদুঃখকর অধ্যবসায় আছে তাহা পৃথিবীর সর্বত্রই সৰ্বকালেই নানা উপলক্ষে নানা অসম্ভব প্রত্যাশায় অসাধ্যসাধনে বারংবার দগ্ধপক্ষ পতঙ্গের ন্যায় নিশ্চিত পরাভাবের বহ্নিশিখায় অন্ধভাবে বঁপ দিয়া পড়িতেছে। - যাই হােক, যেমন করিয়াই হােক, শক্তির অভিমান আঘাত পাইয়া জাগিয়া উঠিলে সেটা জাতির পক্ষে যে অনিষ্টকর তাহা বলা যায় না। তবে কিনা বিরোধের ক্রুদ্ধ আবেগের দ্বারা আমাদের এই উদ্যম হঠাৎ আবির্ভূত হইয়াছে বলিয়াই আমাদের মধ্যে কেহ কেহ দেশের শক্তিকে বিরোধের মূর্তিতেই প্রকাশ করিবার দুবুদ্ধি অস্তরে পোষণ করিতেছেন । কিন্তু যাহারা সহজ অবস্থায় কোনোদিন স্বাভাবিক অনুরাগের দ্বারা দেশের হিতানুষ্ঠানে ক্রমান্বয়ে অভ্যস্ত হয় নাই, যাহারা উচ্চ সংকল্পকে বহুদিনের ধৈৰ্যে নানা উপকরণে নানা বাধাবিদ্মের ভিতর দিয়া গড়িয়া তুলিবার কাজে নিজের প্রকৃতিকে প্রস্তুত করে নাই, অনেক দিন ধরিয়া রাষ্ট্রচালনার বৃহৎ কার্যক্ষেত্র হইতে দুৰ্ভাগ্যক্রমে বঞ্চিত হইয়া যাহারা ক্ষুদ্র স্বার্থের অনুসরণে সংকীর্ণভাবে জীবনের কাজ করিয়া আসিয়াছে, তাহারা হঠাৎ বিষম রাগ করিয়া এক নিমেষে দেশের একটা মস্ত হিত করিয়া ফেলিবে ইহা কোনোমতেই সম্ভবপর হইতে পারে না । ঠাণ্ডার দিনে নীেকার কাছেও ঘোষিলাম না, তুফানের দিনে তাড়াতাড়ি হাল ধরিয়া অসামান্য মাঝি বলিয়া দেশে বিদেশে বাহবা লইব এইরূপ আশ্চর্য ব্যাপার স্বপ্নে ঘটাই সম্ভব । অতএব আমাদিগকেও কাজ একেবারে সেই গোড়ার দিক হইতেই শুরু করিতে হইবে । তাহাতে বিলম্ব হইতে পারে- বিপরীত উপায়ে আরো অনেক বেশি বিলম্ব হইবে। মানুষ বিস্তীর্ণ মঙ্গলকে সৃষ্টি করে তপস্যা দ্বারা। ক্ৰোধে বা কামে সেই তপস্যা ভঙ্গ করে, এবং তপস্যার ফলকে এক মুহুর্তে নষ্ট করিয়া দেয়। নিশ্চয়ই আমাদের দেশও কল্যাণময় চেষ্টা নিভৃতে তপস্যা করিতেছে ; দ্রুত ফললাভের লোভ তাহার নাই, সাময়িক আশাভঙ্গের ক্রোধকে যে সংযত করিয়াছে ; এমন সময় আজ অকস্মাৎ ধৈর্যহীন উন্মত্তত যজ্ঞক্ষেত্রে রক্তবৃষ্টি করিয়া তাহার বহুদুঃখসঞ্চিত তপস্যার ফলকে কলুষিত করিয়া নষ্ট করিবার উপক্ৰম করিতেছে। । ক্ৰোধের আবেগ তপস্যাকে বিশ্বাসই করে না । তাহাকে নিশ্চেষ্টতা বলিয়া মনে করে, তাহাকে নিজের আশু উদ্দেশ্যসিদ্ধির প্রধান অন্তরায় বলিয়া ঘূণা করে ; উৎপাতের দ্বারা সেই তপঃসাধনাকে চঞ্চল সুতরাং নিস্ফল করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া প্রবৃত্ত হয়। ফলকে পাকিতে দেওয়াকেই সে ঔদাসীন্য বলিয়া জ্ঞান করে, টান দিয়া ফলকে ছিড়িয়া লওয়াকেই সে একমাত্র পৌরুষ বলিয়া জানে । সে মনে করে, যে মালী প্রতিদিন গাছের তলায় জল সেচন করিতেছে গাছের ডালে উঠিবার সাহস নাই বলিয়াই তাহার এই দীনতা । এ অবস্থায় মালীর উপর তাহার রাগ হয়, জল দেওয়াকে সে ছোটো কাজ মনে করে। উত্তেজিত অবস্থায় মানুষ উত্তেজনাকেই জগতের মধ্যে সকলের চেয়ে বড়ো সত্য বলিয়া জানে ; যেখানে তাহার অভাব দেখে, সেখানে সে কোনো সার্থকতাই দেখিতে পায় না । কিন্তু স্মৃলিঙ্গের সঙ্গে শিখার যে প্রভেদ উত্তেজনার সঙ্গে শক্তির সেই প্ৰভেদ । চকমকি ঠুকিয়া যে স্মৃলিঙ্গ বাহির হইতে থাকে তাহাতে ঘরের অন্ধকার দূর হয় না। তাহার আয়োজন স্বল্প, তেমনি তাহার প্রয়োজনও সামান্য। প্রদীপের আয়োজন অনেক ; তাহার আধার গড়িতে হয়, সলিতা পাকাইতে হয়, তাহার তেল জোগাইতে হয় । যখন যথাযথ মূল্য দিয়া সমস্ত কেনা হইয়াছে এবং পরিশ্রম করিয়া সমস্ত প্ৰস্তুত হইয়াছে তখনই প্রয়োজন হইলে স্মৃলিঙ্গ প্রদীপের মুখে আপনাকে স্থায়ী শিখায় পরিণত করিয়া ঘরকে আলোকিত করিয়া তুলিতে পারে। যখন উপযুক্ত চেষ্টার দ্বারা সেই প্ৰদীপ-রচনার আয়োজন করিবার উদ্যম জাগিতেছে না, যখন শুদ্ধমাত্র ঘন ঘন চকমকি ঠোকার চাঞ্চল্যমাত্রেই সকলে আনন্দে অভিভূত হইয়া উঠিতেছি, তখন সত্যের অনুরোধে স্বীকার করিতেই হইবে, এমন করিয়া কখনোই ঘরে আলো জ্বলিবে না, কিন্তু ঘরে আগুন লাগা অসম্ভব নহে। কিন্তু শক্তিকে সুলভ করিয়া তুলিবার চেষ্টায় মানুষ উত্তেজনার আশ্রয় অবলম্বন করে। এ কথা ভুলিয়া যায় যে, এই অস্বাভাবিক সুলভতা এক দিকে মূল্য কমাইয়া আর-এক দিক দিয়া এমন করিয়া