পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ve সমূহ পারিতেছেন না- যখন নিশ্চয় জানি অদ্যকার দিনে সভাপতির আসন সুখের আসন নহে এবং হয়তো ইহা সম্মানের আসনও না হইতে পারে- অপমানের আশঙ্কা চতুর্দিকেই পুঞ্জীভূত- তখন আপনাদের এই আমন্ত্রণে বিনয়ের উপলক্ষ করিয়া আজ আর কাপুরুষের মতো ফিরিয়া যাইতে পারিলাম না, এবং বিশ্বজগতের সমস্ত বৈচিত্র্য ও বিরোধের মাঝখানে “যি একঃ’ যিনি এক, অবৰ্ণঃ’ মানবসমাজের বিবিধ জাতির মাঝখানে জাতিহীন যিনি বিরাজমান, যিনি “বহুধা শক্তিযোগাৎ বর্ণন অনেকান নিহিতার্থে দধাতি বহুধা শক্তির দ্বারা নানা জাতির নানা প্রয়োজন বিচিত্ররূপে সম্পাদন করিতেছেন, “বিচৈতিচান্তে বিশ্বমাদীে বিশ্বের সমস্ত আরম্ভেও যিনি সমস্ত পরিণামেও যিনি, ‘স দেবঃ স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনতু সেই দেবতা তিনি আমাদের এই মহাসভায় শুভবুদ্ধিস্বরূপ বিদামান থাকিয়া আমাদের হৃদয় হইতে সমস্ত ক্ষুদ্রতা অপসারিত করিয়া দিন, আমাদের চিত্তকে পরিপূর্ণ প্রেমে সম্মিলিত এবং আমাদের চেষ্টাকে সুমহৎ লক্ষ্যে নিবিষ্ট করুন— একান্তমনে এই প্রার্থনা করিয়া, অযোগ্যতার বাধা সত্ত্বেও এই মহাসভায় সভাপতির আসন গ্ৰহণ করিতেছি । বিশেষত জানি, এমন সময় আসে যখন অযোগ্যতাই বিশেষ যোগ্যতার স্বরূপ হইয়া উঠে । এতদিন আমি দেশের রাষ্ট্রসভায় স্থান পাইবার জন্য নিজেকে প্ৰস্তুত করি নাই । ইহাতে আমার ক্ষমতার অভাব এবং স্বভাবেরও ক্রটি প্রকাশ পাইয়াছে । করিয়া, সভাপতির উচ্চ আসনটিকে নিরাপদ করিবার জন্যই, আমাকে আপনারা এইখানে বসাইয়া দিয়াছেন । আপনাদের সেই ইচ্ছা যদি সফল হয় তবেই আমি ধন্য হইব । কিন্তু রামচন্দ্ৰ সত্যপালনের জন্য নির্বাসনে গেলে পর ভরত যেভাবে রােজ্যরক্ষার ভার লইয়াছিলেন আমিও তেমনি আমার নমস্য জ্যেষ্ঠগণের খড়মজোড়াকেই মনের সম্মুখে রাখিয়া নিজেকে উপলক্ষীস্বরূপ এখানে স্থাপিত করিলাম। রাষ্ট্রসভার কোনো দলের সহিত আমার যোগ ঘনিষ্ঠ নহে বলিয়াই, সম্প্রতি কনগ্রেসে যে আত্মবিপ্লব ঘটিয়াছে তাহাকে আমি দূর হইতে দেখিবার সুযোগ পাইয়াছি। র্যাহারা ইহার ভিতরে ছিলেন র্তাহারা স্বভাবতই এই ব্যাপারটাকে এতই উৎকট করিয়া দেখিয়াছেন ও ইহা হইতে এতই গুরুতর অহিতের আশঙ্কা করিতেছেন যে, এখনো তঁহাদের মনের ক্ষোভ দূর হইতে পারিতেছে না। কিন্তু ঘটনায় যাহা নিঃশেষ হইয়াছে বেদনায় তাহাকে বাধিয়া রাখিবার চেষ্টা করা বলিষ্ঠ প্রকৃতির লক্ষণ নহে। কবি বলিয়াছেন, যথার্থ প্রেমের স্রোত অব্যাহতভাবে চলে না। যথার্থ জীবনের স্রোতও সেইরূপ, যথার্থ কর্মের স্রোতেরও সেই দশা । দেশের নাড়ীর মধ্যে প্ৰাণের বেগ চঞ্চল হইয়া উঠাতেই কর্মে যদি মাঝে মাঝে এরূপ ব্যাঘাত ঘটিয়া পড়ে তবে ইহাতে হতাশ না হইয়া এই কথাই মনে রাখিতে হইবে যে, যে জীবনধর্মের অতিচাঞ্চল্যে কনগ্রেসকে একবার আঘাত করিয়াছে সেই জীবনধর্মই এই আঘাতকে অনায়াসে অতিক্রম করিয়া কনগ্রেসের মধ্যে নূতন স্বাস্থের সঞ্চার করিবে । মৃত পদার্থই আপনার কোনো ক্ষতিকে ভুলিতে পারে না। শুষ্ক কাষ্ঠ যেমন ভাঙে তেমনি ভাঙাই থাকে, কিন্তু সজীব গাছ নূতন পাতায় নূতন শাখায় সর্বদাই আপনার ক্ষতিপূরণ করিয়া বাড়িয়া উঠিতে থাকে। অতএব সুস্থ দেহ যেমন নিজের ক্ষতকে শীঘ্রই শোধন করিতে পারে তেমনি আমরা অতিসত্বর দুপুর মাধ্যতক্ষকে আরোগে ইয়া যাইব এবং সেইসঙ্গে এই ঘটনার শিক্ষকও নয়ভাবে গ্ৰহণ সে শিক্ষাটুকু এই যে, যখন কোনো প্রবল আঘাতে মানুষের মন হইতে ঔদাসীন্য ঘুচিয়া যায় এবং সে উত্তেজিত অবস্থায় জাগিয়া উঠে তখন তাহাকে লইয়া যে কাজ করিতে হইবে সে কাজে মতের বৈচিত্র্য এবং মতের বিরোধ সহিষ্ণুভাবে স্বীকার করিতেই হইবে। যখন দেশের চিত্ত নিজীব ও উদাসীন থাকে তখনকার কাজের প্রণালী যেরূপ, বিপরীত অবস্থায় সেরাপ হইতেই পারে না । এই সময়ে, যাহা অপ্রিয় তাহাকে বলপূর্বক বিধ্বস্ত এবং যাহা বিরুদ্ধ তাহাকে আঘাতের দ্বারা নিরস্ত করিবার চেষ্টা করা কোনোমতেই চলে না। এমন-কি, এইরূপ সময়ে হার মানিয়াও জয়লাভ করিতে হইবে ; জিতিবই পণ করিয়া বসিলে সে জিতের দ্বারা যাহাকে পাইতে ইচ্ছা করি তাহাকেই খণ্ড খণ্ড