পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট \O6 পূৰ্বদেশীয়দের এই নীরব সহিষ্ণুতা যাহাতে পশ্চিমদেশীয়দিগকে অলক্ষ্যে অসতর্কতা ও ঔদ্ধত্যে । লইয়া যায়, ইহাই প্রাচ্য প্রজা ও পাশ্চাত্য রাজা উভয়েরই পক্ষে বিপদের মূল। ইহা হইতেই গোরা সৈন্যদের মজার খেলা ও কালা আদমিদের অকস্মাৎ উন্মত্ততার সৃষ্টি হয়। যাহা হউক, এইরূপ সংঘটন এবং সংঘর্ষে প্রজাদের আন্তরিক সন্তাপ যে কিরূপ বাড়িয়া উঠিতেছে তাহা পরিমাণ করিবার উপায় নাই। যে-সকল ইংরাজ কথায় কথায় ঘুষা লাথি চড়, এবং ‘শৃয়র নিগর’ সম্ভাষণ প্রয়োগ করিতে সর্বদা প্ৰস্তুত তাহারা প্রত্যহই ভারতবর্ষে কিপ্রকার বিপৎপাতের ভিত্তি রচনা করিতেছেন তাহা তাহারা জানেন না, এবং যে ইংরাজসমাজ এইরূপ রূঢ়তা ও অবজ্ঞাপরতার বিরুদ্ধে, কোনোপ্রকার নৈতিক বাধা প্ৰদান করেন না। তাহারা যে শাখায় বসিয়া আছেন সেই শাখা ছেদনে প্ৰবৃত্ত । আমাদের প্রতি সাধারণ ইংরাজের এইপ্ৰকার ভােবই প্ৰজাবিদ্রোহের ভাব । তাহারা আচারে ব্যবহারে ভাষায় ভঙ্গিতে সর্বদাই আমাদের মর্মস্থানকে ক্ষুব্ধ করিতেছেন । এমন-কি, তঁহাদের মধ্যে এমন মূঢ়চেতারও অভাব নাই যাহারা অসহ্য অবজ্ঞার আঘাতে প্রজাহাদয়ে অপমানক্ষত সর্বদা জাগাইয়া রাখাই রাজনৈতিক হিসাবে কর্তব্য জ্ঞান করেন । তাহারা পথে চলিতে চাবুক তুলিয়া সেলাম শিখাইতে শিখাইতে অগ্রসর হন । ইহাকেই বলে প্ৰজাবিদ্রোহ এবং নিয়ত এই বিদ্রোহেই প্ৰজার হইয়া প্ৰজাপতির কালাগি উত্তরোত্তর প্ৰজ্বলিত হইতে থাকে । ইংরাজ কি সেই চিরজাগ্ৰত প্ৰজাপালকের বিশ্বনিয়মের প্রতিও প্ৰভুত্বমদৌদ্ধত ভুকুটি নিক্ষেপ করবেন! প্রজাদের সংবাদপত্র সভাসমিতি এবং বাগ্মীবৰ্গ আছে, রুদ্রমূর্তি রাজা মুহূর্তের মধ্যে তাহাদের বাগরোধ করিয়া দিতে পারেন ; কিন্তু প্রজাপতির সভা নিঃশব্দ নীরব এবং ֆ ՖO (; ܔ পরজাতীয়ের প্রতি বিদ্বেষ যে স্বাভাবিক এবং কিয়ৎপরিমাণে তাহার সার্থকতা আছে। এ সম্বন্ধে সম্প্রতি ইংরাজি স্পেক্টেটর পত্রে একটি প্ৰবন্ধ বাহির হইয়াছে ৷ ” একটা জাতি বাধিয়া তুলিতে অনেক সময় যায়। আজ যাহারা ইংরাজ-জাতি বলিয়া খ্যাত তাহারা জুলিয়স সীজরের আক্রমণকাল হইতে এডওঅর্ড দি কনফেসরের রাজত্বকাল পর্যন্ত হাজার বৎসর ধরিয়া পরিপাক পাইয়া। তবে প্ৰস্তুত হইয়াছে । এই সময়ের মধ্যে কেল্ট রোমান অ্যাঙ্গল জুট ডেন স্যাকসন নর্মান প্রভৃতি বিচিত্র ভিন্ন জাতি এক ঐতিহাসিক চুল্লির উপরে চড়ানো ছিল । তাহাদের মধ্যে প্রভেদ ও বিরোধ ঘুচিয়া যখন তাহারা ঘনভাবে এক হইয়া উঠিল তখন তাহারা ব্রিটিশ-জাতিরূপে গণ্য হইল । এত দীর্ঘকালনির্মিত জাতীয়তা পরের সংঘাত হইতে আপনাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করিবার জন্য স্বভাবতই উদ্যত হইয়া থাকে। ধর্মনীতি সমাজনীতি অর্থনীতি সম্বন্ধে তাহার সংস্কারসকল এমন একান্ত বিশেষত্ব ও দৃঢ়তা লাভ করে যে, তাহার মধ্যে বহির্জাতির প্রবেশপথ থাকে না । ভারতবর্ষের হিন্দুগণ বিশেষ একটি জাতি বলিয়া গণ্য হইতে পারে কি না তাহা লইয়া কেহ কেহ তর্ক উত্থাপন করেন । সে তর্ক অসংগত নহে । k . জগতে হিন্দুজাতি এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত । ইহাকে বিশেষ জাতি রূপে গণ্য করা যায় এবং যায়ও না । জাতীয়ত্বের সংকীর্ণতা ইহার মধ্যে আছে। অথচ জাতীয়ত্বের বল ইহার মধ্যে নাই। ইহা এক অথচ অনেক, ইহা বিপুল অথচ দুর্বল। ইহার বন্ধন যেমন কঠিন তেমনি শিথিল, ইহার সীমা যেমন দৃঢ় তেমনি অনির্দিষ্ট । য়ুরোপে জাতিগত উপাদানে রাজনৈতিক ঐক্যই সর্বপ্রধান । হিন্দুদের মধ্যে সেটা কোনোকালেই