পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓd S রবীন্দ্র-রচনাবলী করিত। সেই সাধারণের সম্মানের প্রতি তাঁহাদের উপেক্ষা ছিল না। রানী ভবানী, রাজা কৃষ্ণচন্দ্ৰ, ইহারা তৎকালীন নবাব-দত্ত বিশেষ অনুগ্রহের দ্বারা উজ্জ্বল নহেন, ইহারা বিচিত্র কীর্তি-দ্বারা লোকসাধারণের হৃদয়ের মধ্যে আপন অক্ষয় মূর্তি স্থাপন করিয়াছেন। তখন জনগণের নিকট হইতে হিতকারী দেশপতিগণ যে খেতাব লাভ করিতেন তাহা আধুনিক দেশী বিলাতি সর্বপ্রকার খেতাবের অপেক্ষা অনেক উচ্চ, তাহা নিম্নে উদধূত হইল আর্তনাম ইহ জন্তুনাম আর্তিচ্ছেদং করোতি যঃ শঙ্খচক্ৰগদাহীনো দ্বিভুজঃ পরমেশ্বরঃ । কীৰ্তিস্থাপনের দ্বারা লোকহিতসাধন অথবা সাধারণের নিকট খ্যাতিলাভ এখনকার ধনীগণের নিকট তেমন স্পাহনীয় নহে। আরব্য উপন্যাসে সিন্ধবাদের কাহিনীতে পড়া যায় যে, চুম্বকৗশলের আকর্ষণে দূর হইতে জাহাজের সমস্ত লোহার পেরেক ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিত, তেমনি আমাদের যে-সকল ধনী জমিদার আপনি আপন ভূখণ্ডের মধ্যে দৃঢ়ভাবে নিহিত ছিলেন, দানধােন ক্রিয়াকলাপ এবং লোকহিতকর বিচিত্র স্থায়ী কীৰ্তি-দ্বারা এই জীৰ্ণ দেশটাকে একপ্রকার জুড়িয়া রাখিয়া বহুলোকবহনকাৰ্য সম্পন্ন করিতেছিলেন, প্রবল ইংরাজ-রাজার সমুচ্চ চুম্বকশৈল অলক্ষ্যে অনায়াসে। তঁহাদিগকে দেশের লোকের নিকট হইতে ছিড়িয়া যেন একমাত্র নিজের দিকে আকর্ষণ করিয়া আনিতেছে। সমস্ত পূজা-অৰ্চনা দান-দক্ষিণা সাহেবের অভিমুখে, সমস্ত খ্যাতি-প্রতিপত্তি সম্মান-সমােদর সাহেবের হস্ত হইতে । সেকালে রাজার আকর্ষণ এবং স্বদেশী সাধারণের আকর্ষণ অন্তত সমান ছিল- নবাব-বাদশারা আমাদের ধনী জমিদারগণকে দেশের কােছ হইতে এমন করিয়া টানিয়া গ্ৰাস করিতে পারে নাই ; কর্তব্য-অকর্তব্যের আদর্শ, স্তুতি-নিন্দার চরম দণ্ড-পুরস্কার-বিধান দেশের লোকের হাতে ছিল। অতএব দেখা যাইতেছে, সেকালে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সর্বসাধারণের সহিত যে হিতানুষ্ঠানসূত্রে বদ্ধ ছিলেন একালে তাহাও নাই, আবার নিজেদের মধ্যে একটা অভিজাতমণ্ডলী বন্ধন করিয়া সম্প্রদায়গাত মহত্ত্বকে অক্ষুন্নভাবে রক্ষণ ও পোষণ তাহারও সম্ভাবনা নাই। ইহারা নিজ গৌরবেও উচ্চ নহেন, সর্বসাধারণের সহিত ঐক্য-দ্বারাও বৃহৎ বলিষ্ঠ নহেন। ইহারা বিলাতের লর্ডদের ন্যায় স্বতন্ত্র নহেন, বিলাতের জননায়কদের ন্যায়ও প্রবল নহেন । ইহারা বনস্পতির ন্যায় বিচ্ছিন্ন বৃহৎ নহেন, ওষধির মতো ব্যাপ্ত বিস্তৃতও নহেন, ইহারা কুষ্মাণ্ডলতার ন্যায় একমাত্র গবর্মেন্টের আশ্রয়যষ্টি বাহিয়া উন্নতির পথে চড়িতে চাহেন— ভুলিয়া যান যে, সেই সংকীর্ণ রাজদণ্ডবাহী উচ্চতা অপেক্ষা গুল্মসমাজের খর্বতা শ্রেয় এবং তৃণসমাজের নম্রতা শোভন । পুরাকালের বড়ো জমিদারগণ রাস্তাঘাট করিয়া সাধারণের অভাবমোচন, যাত্রাগান প্রভৃতি উৎসবের দ্বারা সাধারণের আমোদ-বিধান, এবং গুণী পণ্ডিত ও কবিদের প্রতিপালন-দ্বারা দেশের শিল্পসাহিত্যের "রক্ষণ ও পালন করিতেন । তাহারাই আমাদের দেশে দানশীলতার ও সমাজহিতৈষার উচ্চ আদর্শ জাগ্ৰত করিয়া রাখিয়াছিলেন। শুভানুষ্ঠান উপলক্ষে ত্যাগন্ধীকারে পরাভূখত যে লজ্জাকর তাহা র্তাহারাই দেশের হৃদয়ে বদ্ধমূল করিয়াছিলেন। বর্তমান জমিদারগণ যদি সেকালের দৃষ্টান্ত অনুসারে, কেবল রাজার মুখ না। চাহিয়া খেতাবের লক্ষ্য ছাড়িয়া, জনহিতসাধন ও দেশের শিল্পসাহিত্যের রক্ষণ-পালনে সহায়তা করেন তবেই তীহাদের ক্ষমতার সার্থকতা হয় এবং গীেরব বাড়িয়া উঠে । যখন আমাদের রাজা বিদেশী, এবং তঁহাদের রুচি ভাষা ও সাহিত্য স্বতন্ত্র, তখন দেশী ভাষা ও সাহিত্যের অবহেলা অবশ্যম্ভাবী। যাহারা জীবিকাসংগ্রামে প্রবৃত্ত, বাংলা ভাষার দিকে তাকাইবার সময় তঁহাদের নাই। সর্বত্রই দেশের ধনীগণ স্বদেশীয় তরুণ সাহিত্যের পালনকর্তা । আমাদের কিন্তু মুখ্য জমিদারগণ- জমিদার-সভার প্রধান প্রতিনিধিবর্গ ইংরাজি শেখেন, ইংরাজি লেখেন, ইংরাজি বলেন । পিতাকেও চিঠি লিখিতে ইংরাজি ভাষা ব্যবহার করেন । তাহারা বলেন, ইংলন্ডের