পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

A VV রবীন্দ্র-রচনাবলী একটি কারণ এই যে, আমরা একান্নাবতী পরিবারে মানুষ হইয়াছি- পরস্পর মিলিয়া-মিশিয়া থাকিবার যত-কিছু আদেশ-উপদেশ-অনুশাসন সমস্তই শিশুকাল হইতে আমাদিগকে প্রত্যহ পালন করিতে হইয়াছে। ঘুষাঘুষি করা, বিবাদ করা, পরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা ও নিজের অধিকার লড়াই করিয়া রাখা, একান্নাবতী পরিবারে কিছুতেই চলে না। আমাদের পরিবার ভালোমানুষ হইবার, পরস্পরের অনুকূলকারী হইবার, একটি কারখানাবিশেষ। অতএব ঘুষিশিক্ষা করিলেও মানুষের নাসিকাগ্রে ও চক্ষুতারকায় তাহা নির্বিচারে প্রয়োগ করিবার ক্ষিপ্রকারিতা আমাদের অভ্যাস হয় না। নিজের অসুবিধা করিয়াও পরস্পরের সহিত মিলিবার ভােবই আমাদের স্বভাব ও অভ্যাস -সংগীতপরস্পরের সহিত লড়িবার ভােব আমাদের সমাজব্যবস্থার মধ্যে কোথাও স্মৃর্তি পাইবার স্থান পায় নাই। এক, ইস্কুলে ছেলেদের মধ্যে যেটুকু বীররসের অবসর আছে, কর্তৃপক্ষ তাহা সহজে প্রশ্রয় দিতে চান না । তারা কেবলই বলেন, আমাদের ছাত্ৰাদিগকে যথেষ্ট শাসনে রাখা হয় না । তঁহাদের স্বদেশে ছাত্রেরা যে ভাবে মানুষ হয় এ দেশের ছাত্রদের ব্যবহারে তাহার আভাসমােত্রও র্তাহারা সহ্য করিতে পারেন না। যাহা দলন করিতে হইবে তাহা অঙ্কুরেই দলন করা ভালো, এ কথা ইংরাজ জানে। একটা দৃষ্টান্ত দিই। কোনো কলেজের ছাত্র ফুটবল খেলিতে খেলিতে আহত হইয়াছিল। তাহার সঙ্গীরা শুশ্রুষার প্রয়োজনে কাছের একটি সরোবর হইতে কাপড়ে ভিজাইয়া জল লইয়াছিল। সেই সরোবর সাহেবদের পানীয় জলের জন্য সুরক্ষিত ছিল। সেখানে ছাত্রকে নাবিতে দেখিয়া পাহারাওয়ালা নিষেধ করে । সেই উপলক্ষে উভয়পক্ষে বাচসা, এমন-কি, হাতাহাতিও হইয়া থাকিবে । ম্যাজিষ্ট্রেট সেই ছাত্ৰকয়টিকে লইয়া দীর্ঘকাল তাহার ডিস্ট্রিক্টর যত দুৰ্গম স্থানে যে কৌশলে ঘুরাইয়া মারিয়া অবশেষে জরিমানা করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, তাহা সেই ছাত্ৰগণ ও তাঁহাদের অভিভাবকেরা কোনো কালে ভুলিতে পরিবে না। বাল্যলীলার এরূপ দণ্ডবিধি ইংরাজের নিজের দেশে যে নাই সে কথা সকলেই জানেন । প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো বিদ্যালয়েও, দেশীয় প্রিন্সিপালের বিচারেও, ছাত্ৰাদিগকে যে-সকল লঘুপাপে গুরুদণ্ড সহ্য করিতে হয় তাহাতে তাহাদের পৌরুষচর্চা হয় না । এই তো গেল। ঘরে এবং বিদ্যালয়ে। তাহার পরেও যদি ইংরাজ-অন্যায়কারীর গায়ে ঘুষি তুলিবার মতো স্মৃর্তি কাহারও থাকে, তবে বিচারালয় আছে। দেশীয়দের বিরুদ্ধাচারী ইংরাজ-ক্রিমিনালের প্রতি ইংরাজ-বিচারকের মানবস্বভাবসংগত পক্ষপাত সম্পাদকমহাশয় স্বীকার করেন- সেই স্বাভাবিক পক্ষপাত দেশীয় অপরাধীর পক্ষে কী আকার ধারণ করিতে পারে তাহা অনুমান করা কঠিন নহে। একজন সন্ত্রান্ত মুসলমান যুবা গড়ের মাঠে গাড়ি হইতে অন্য গাড়ির একজন ইংরাজকে চাবুক মারিয়া জেলে গিয়াছিল মনে আছে, এলাহাবাদের সোমেশ্বর দাসের কথাও আমরা ভুলিতে পারি না। ইংরাজের গায়ে হাত দিতে গিয়া গ্রামসুদ্ধ দোষী-নির্দোষী বহুতর লোকের কিরূপ অসহ্য লাঞ্ছনা ঘটে, তাহার দৃষ্টান্ত আছে। তাহার কারণ, এ দেশে পোলিটিকাল নীতিতে অন্য নীতিকে জটিল করিয়া ফেলে। এ দেশে ইংরাজকে মারার মধ্যে ব্যক্তিগত মার এবং পোলিটিকাল মার, দুই আছে- ইস্কুলের ছেলের তুচ্ছ ক্ৰীড়ার মধ্যে ভাবীকালের পোলিটিকাল সংকটের বীজ প্রচ্ছন্ন আছে- সুতরাং আমাদের ব্যক্তিগত অপমানের প্রতিকার করিতে গিয়া আমরা হঠাৎ পোলিটিকালের মধ্যে পা দিয়া ফেলি, তখন - সহসা কঁাধের উপরে যে দণ্ডটা আসিয়া পড়ে তাহার সম্পূর্ণ তাৎপর্য বুঝিতে আমাদের কিছু বিলম্ব হয় । দেশীয়ের প্রতি উপদ্রব করিয়া ইংরাজ অল্প দণ্ড ও ইংরাজের গায়ে হাত দিয়া-আমরা গুরু দণ্ড পাই, ইহার মধ্যে শুধু যে মনুষ্যধৰ্ম আছে তাহা নহে-তাহার সঙ্গে রাজধর্মও যোগ দিয়াছে। এ স্থলে ঘুষি তোলা কম কথা নহে। মনুষ্যস্বভাবে সাহসের একটা সীমা আছে। জাহাজের একজন কপ্তেন হাজার অন্যায়কারী হইলেও তাহার অধীনস্থ য়ুরোপীয় নাবিকদল সংখ্যাধিক্যসত্ত্বেও সকলপ্রকার অপমান ও দৌরাত্ম্য অগত্যা সহ্য করিয়াছে, এরাপ ঘটনার কথা অনেক শুনা গিয়াছে । আইনের শাসনকে উপেক্ষা করা শক্ত । জস্টিস হিল ইংরাজ-ক্রিমিনালকে উপদেশ দিবার প্রসঙ্গক্রমে বলিয়াছেন, “তোমার স্বদেশীয় ভৃত্য তোমার এরূপ ব্যবহার সহ্য করিত না ’ না করিবার কারণ আছে। বিচারের চক্ষে স্বদেশীয় ভূত্য ও স্বদেশীয়