পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৮২৬ – রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ১৯০৮ সালে (১৩১৪-১৫) মজঃফরপুরে বোমা-নিক্ষেপে দুইজন ইংরাজ-মহিলা নিহত হইলে ও মানিকতলায় বোমার কারখানা আবিষ্কার হইলে রবীন্দ্ৰনাথ ‘পথ ও পাথেয়' প্ৰবন্ধ রচনা করিয়া ও সভায় তাহা পাঠ করিয়া এ বিষয়ে নিজের অভিমত প্ৰকাশ করেন ; এ সময়ে এই সম্পর্কে শ্ৰীমতী নিঝরিণী সরকারের জিজ্ঞাসার উত্তরে রবীন্দ্ৰনাথ যাহা লেখেন, সেরূপ কয়েকখানি পত্র এ স্থলে সংকলনযোগ্য মাতঃ, ইহা নিশ্চয় মনে রাখিবে, নিজের, বা পরিবারের বা দেশের কাজে ধর্মকে লঙ্ঘন করিলে ঈশ্বর ক্ষমা করেন না । যদি মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও পাপকে আশ্রয় করি তবে তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিতেই হইবে । বিধাতার এই নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বৃথা । দেশের যে দুৰ্গতিদুঃখ আমরা আজ পর্যন্ত ভোগ করিয়া আসিতেছি তাহার গভীর কারণ আমাদের জাতির অভ্যন্তরে নিহিত হইয়া রহিয়াছে’- গুপ্ত চক্রাস্তের দ্বারা নরনারী হত্যা করিয়া আমরা সে কারণ দূর করিতে পারিব না। আমাদের পাপের বোঝা কেবল বাড়িয়াই চলিবে । এই ব্যাপারে যে-সকল অপ্ৰাপ্তবয়স্ক বালক ও বিচলিতবুদ্ধি যুবক দণ্ডনীয় হইয়াছে তাহাদের জন্য হৃদয় ব্যথিত না হইয়া থাকিতে পারে না- কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, এই দণ্ড আমাদের সকলের দণ্ড— ঈশ্বর আমাদিগকে এই বেদনা দিলেন- কারণ, বেদনা ব্যতীত পাপ দূর হইতেই পারে নাসহিষ্ণুতার সহিত এ-সমস্তই আমাদিগকে বহন করিতে হইবে- এবং ধর্মের প্রশস্ততর পথকেই অবলম্বন করিতে হইবে । পাপের পথে পথ-সংক্ষেপ হয় বলিয়া আমরা ভ্ৰম করি, সেইজন্যই অধৈর্য হইয়া আমরা সেই দিকে ধাবিত হই, কিন্তু তাড়াতাড়ি করিতে গিয়াই সফলতাকে বিসর্জন দিই। আজ আমাদের পথ পূর্বের অপেক্ষা অনেক বাড়িয়া গেল— এখন আবার আমাদিগকে অনেক দুঃখ, অনেক বাধা, অনেক বিলম্বের মধ্য দিয়া যাইতে হইবে । ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে মাথা নত করিয়া পুনর্বার আমাদিগকে যাত্ৰা করিতে হইবে— যত কষ্ট হউক, যত দূরপথ হউক, অবিচলিতচিত্তে যেন ধর্মেরই অনুসরণ করি । সমস্ত দুর্ঘটনা সমস্ত চিত্তক্ষোভের মধ্যে ঈশ্বর যেন আমাদিগকে সেই শুভবুদ্ধি দান করেন । ইতি ২৩শে বৈশাখ ১৩১৫ মাতঃ, তুমি যে দুরূহ প্রশ্নের উত্তর জানিতে চাহিয়াছ পত্রের মধ্যে তাহা বিস্তারিতভাবে ব্যক্ত করা অসম্ভব । আমি এ সম্বন্ধে একটি প্ৰবন্ধ লিখিতে প্ৰস্তুত হইয়াছি, তাহাতে আমার মত যথাসম্ভব স্পষ্ট করিয়া প্ৰকাশ করিতে চেষ্টা করিব । সম্ভবত ভারতীতে তাহা বাহির হইবে এবং যদি কর্তব্য বোধ করি তবে কোনো সভাতেও তাহা পাঠ করিতে পারি । উদার দৃষ্টি দ্বারা জগদব্যাপারকে বৃহৎ করিয়া দেখিতে থাকো— সমস্ত বিয়বিপত্তি ও দুর্বিষহ দুঃখতাপের মধ্যেও ঈশ্বরের মঙ্গলইচ্ছার প্রতি বিশ্বাসকে স্থির করিয়া তোমার করুণাপূর্ণ ব্যথিত চিত্ত সাস্তুনা লাভ করুক, এই আমি আশীর্বাদ করি । ইতি ২রা জ্যৈষ্ঠ ১৩১৫ । • আমার প্রবন্ধ সভাস্থলে পড়া হয়ে গেছে । পুস্তিকা আকারে ছাপা হচ্ছে- তোমাকে দুই-একদিনের মধ্যেই পাঠিয়ে দেব। এই কথা মনে রেখো, নিজের জন্যেই কি, আর দেশের জন্যেই কি, যা সকলের চেয়ে উচ্চ সত্য তাই একমাত্র সত্য । কোনো উপস্থিত ক্ৰোধে লোভে বা কোনো ক্ষুদ্র প্রবৃত্তির উত্তেজনায় ধর্মকে খর্ব করতে গেলে কখনও মঙ্গল হতে পারে না। নিজের প্রয়োজন বা প্ৰবৃত্তি অনুসারে ধর্মের উপরে হস্তক্ষেপ না করে মরুভূমির পথে ধ্রুবতারার মতো একাগ্ৰলক্ষ্যে তার দিকে দৃষ্টি রাখলে, দুঃখ পাই আর যাই পাই, পথ হারিয়ে বিনাশের মধ্যে পড়তে হবে না । ইতি ১৭ই জ্যৈষ্ঠ ১৩১৫ -চিঠিপত্র । সপ্তম খণ্ড স্বদেশী আন্দােলনের সময় দমননীতি অবলম্বিত হইলে রবীন্দ্রনাথ যে ‘স্বদেশী আন্দােলনে নিগৃহীতদের প্রতি নিবেদন প্রকাশ করেন তাহাও এইখানে মুদ্রিত হইল—