পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

So রবীন্দ্র-রচনাবলী আরম্ভই শেষ নয় । এই প্রসঙ্গে একটা কথা জানিয়ে রাখি এই বইয়ে যে গীতিনাট্য ছাপানো হয়েছে তার গানগুলিকে কেউ যেন কবিতা বলে সন্দেহ না করেন । সাহিত্য রচনার মধ্যে জীবধর্ম আছে। নানা কারণে তারা সবাই একই পূর্ণতায় দেখা দেয় না । তাদের সবাইকে একত্রে এলোমেলো বাড়তে দিলে সবারই ক্ষতি হয় । মনে আছে এক সময়ে বিজয়া পত্রে বিপিনচন্দ্ৰ পাল আমার রচিত গানের সমালোচনা করেছিলেন । সে সমালোচনা অনুকূল হয় নি। তিনি আমার যে-সব গানকে তলব দিয়ে বিচারকক্ষে দাড় করিয়েছিলেন তাদের মধ্যে বিস্তর ছেলেমানুষ ছিল। তাদের সাক্ষা সংশয় এনেছিল সমস্ত রচনার পরে। তারা সেই পরিণতি পায় নি যার জোরে গীতসাহিত্যসভায় তারা আপনাদের লজ্জা নিবারণ করতে পারে । ইতিহাসের রসদ জোগাবার কাজে ছাপাখানার আড়কাঠির হাতে সাহিত্যমহলে তাদের চালান দেওয়া হয়েছে। তাদের সরিয়ে আনতে গেলে ইতিহাস আপন পুরাতন দাবির দোহাই পেড়ে আপত্তি পেশ করে । আজ যদি আমার সমস্ত রচনার সমগ্র পরিচয় দেবার সময় উপস্থিত হয়ে থাকে। তবে তাদের মধ্যে ভালো মন্দ মাঝারি আপনি আপনি স্থান পাবে। এ কথা মানা যেতে পারে । তারা সবাই মিলেই সমষ্টির স্বাভাবিকতা রক্ষা করে । কেবল যাদের মধ্যে পরিণতি ঘটে নি তারা কোনো এক সময়ে দেখা দিয়েছিল বলেই যে ইতিহাসের খাতিরে তাদের অধিকার স্বীকার করতে হবে এ কথা শ্রদ্ধেয় নয় । সেগুলোকে চোখের আড়াল করে রাখতে পারলেই সমস্তগুলোর সম্মান থাকে । অতএব আমার সমস্ত লেখা সংগ্ৰহ করার মানে হচ্ছে এই যে, যে-সব লেখা অন্তত আমারই রচনার আদর্শ অনুসারে লেখায় প্রস্ফুট হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের একত্র করা । বিধাতার হাতের কাজে অসম্পূর্ণ সৃষ্টি মাঝে মাঝে দেখা দেয়, কিন্তু দেখা দিয়েছে বলেই যে টিকে যায় তা নয়, সম্পূর্ণ সৃষ্টির সঙ্গে সামঞ্জস্য হয় না বলেই তাদের জবাব দেওয়া হয় । সেইরকম জবাব-দেওয়া লাঞ্ছন -ধারী রচনা অনেকগুলিই পাওয়া যাবে এই গ্রন্থের শুরু থেকেই, তাদের ভিড় ঠেলে পাঠকেরা আপন চেষ্টায় যদি পথ করে চলে যান। তবে তাদের প্রতি সদব্যবহার করা হবে। প্রথম বুনোনির সময় যে মাটি বৃষ্টি পায় নি, তার তৃষাের্ত পীড়িত বীজ থেকে কুঞ্চিত হয়ে যে অন্ধুর বেরোয় সে যেমন কিছু একটা প্রকাশ করতে চায় কিন্তু তার পূর্বেই ব্যর্থ হয়ে যায় মরে. সন্ধ্যাসংগীতের কবিতা সেই জাতের । একে সংগ্রহ করে রাখবার মূল্য নেই। এর কেবল একটা দাম আছে, সে হচ্ছে চিত্তচাঞ্চল্যের আবেগে বাধা ছন্দের শিকল ভাঙা । অনেক দিনের রচনাগুলো যখন একত্র জমা করা যায়। তখন এই ভাবনাটা মনে আসে । তারা নানা বয়সের ও মনের নানা অবস্থার সামগ্ৰী । শুধু নিজের মনের নয়। চারি দিকের মনের । ইতিহাসের এই অনিবাৰ্য বৈচিত্র্যের ভিতর দিয়েই সাহিত্যের তরী চলে আপনি তীর্থে । সকলের চেয়ে ভেদ ঘটায় রচনাশক্তির কমিবেশিতে । এক সময়ে বিশেষ রসের আয়োজন মনকে যা টেনেছিল, আর-এক সময়ে তা টানে না, কিংবা অন্যরকম করে টানে । তাতে কোনো ক্ষতি হয় না। যদি তার তৎকালীন প্ৰকাশটা হয় সম্পূর্ণ জোরের সঙ্গে। অনেক সময়ে সেইটেই হয় না। সেটা উপেক্ষার যোগ্য । বয়সের এক পর্বে যা লিখেছি। অন্য পর্বে তা লিখি নে কিংবা হয়তো । অন্যরকম করে লিখি । সেই তার রূপ ও রসের পরিবর্তন যদি যথাসময়ে আপন প্ৰকাশ রীতির যোগ্য বাহন পেয়ে থাকে তা হলে কোনো নালিশ থাকে না । যুগপরিবর্তন ইতিহাসের অঙ্গ, কিন্তু দিয়ে থাকে, সেটা হচ্ছে আমাদের অলংকারশাস্ত্রে যাকে বলে রসতত্ত্ব। এই রস আধুনিকী বা সনাতনী কোনো বিশেষ মালমসলার ফরম্যাশে তৈরি হয় না । কখনো কখনো কোনো অর্থনৈতিক