পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VN) V রবীন্দ্র-রচনাবলী তৃণের সহিত সমতল করিয়া শোয়াও ইহাতেই আন্দাজ করিতেছি, তোমার মনটা পাথরে গড় { বসন্ত রায় নিতান্ত উল্লসিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বাহবা, বাহবা, কবি কী কথাই বলিয়াছেন । সাহেব, যে দুইটি বয়েৎ আজ বলিলে, ঐ দুইটি লিখিয়া দিতে হইবে।” পাঠান ভাবিল, তাহার অদৃষ্ট সুপ্ৰসন্ন । বুড়া, লোক বড়ো সরেস ; গরিবের বহুৎ কাজে লাগিতে পরিবে । বসন্ত রায় ভাবিলেন, আহা, এককালে যে ব্যক্তি বড়োলোক ছিল আজ তাহার এমন দুরবস্থা। চপলা লক্ষ্মীর এ বড়ো অত্যাচার । মনে মনে তিনি কিছু কাতর হইলেন, পাঠানকে কহিলেন, “তোমার যেরকম সুন্দর শরীর আছে তাহাতে তো তুমি অনায়াসে সৈন্যশ্রেণীতে নিযুক্ত হইতে পার ।” পাঠান তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিল, “হুজুর, পারি বৈকি । সেই তো আমাদের কাজ । আমার পিতা-পিতামহেরা সকলেই তলোয়ার হাতে করিয়া মরিয়াছেন, আমারও সেই একমাত্ৰ সাধ আছে । কবি বলেন—” বসন্ত রায় হাসিতে হাসিতে কহিলেন, “কবি যাহাঁই বলুন বাপু, আমার কাজ যদি গ্রহণ কর, তবে তলোয়ার হাতে করিয়া মরিবার সাধ মিটিতেও পারে, কিন্তু সে তলোয়ার খাপ হইতে খোলা তোমার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠিবে না । বুড়া হইয়া পড়িয়াছি, প্রজারা সুখে স্বচ্ছন্দে আছে, ভগবান করুন, আর যেন লড়াই করিবার দরকার না হয় । বয়স গিয়াছে ; তলোয়ার ত্যাগ করিয়াছি । এখন তলোয়ারের পরিবর্তে আর-একজন আমার পাণিগ্রহণ করিয়াছে।” এই বলিয়াই পার্শ্বে শাযিত সহচরী সেতারটিকে দুই-একটি ঝংকার দিয়া একবার জাগাইয়া দিলেন । পাঠান ঘাড় নাড়িয়া চোখ বুজিয়া কহিল, “আহা, যাহা বলিতেছেন, ঠিক বলিতেছেন । একটি বয়েৎ আছে যে, তলোয়ারে শক্রকে জয় করা যায়, কিন্তু সংগীতে শক্রকে মিত্র করা যায় ।” বসন্ত রায় বলিয়া উঠিলেন, “কী বলিলে খ্যা সাহেব ? সংগীতে শক্রকে মিত্র করা যায় ! কী চমৎকার ।” চুপ করিয়া কিয়ৎক্ষণ ভাবিতে লাগিলেন, যতই ভাবিতে লাগিলেন ততই যেন অধিকতর অবাক হইতে লাগিলেন । কিছুক্ষণ পরে বয়েৎটির ব্যাখ্যা করিয়া বলিতে লাগিলেন, “তলোয়ার যে এতবড়ো ভয়ানক দ্রব্য তাহাতেও শত্রুর শক্ৰত্ব নাশ করা যায় না— কেমন করিয়া বলিব নাশ করা যায় ? রোগীকে বধ করিয়া রোগ আরোগ্য করা সে কেমনতরো আরোগ্য ? কিন্তু সংগীত যে এমন মধুর জিনিস, তাহাতে শত্রু নাশ না করিয়াও শক্ৰত্ব নাশ করা যায় । এ কি সাধারণ কবিত্বের কথা ? ঃ, কী তারিফ !” বুদ্ধ এতদূর উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন যে, শিবিকার বাহিরে পা রাখিয়া বসিলেন, পাঠানকে আরো কাছে আসিতে বলিলেন ও কহিলেন, “তলোয়ারে শক্রকে জয় করা যায়, সংগীতে শক্রকেও মিত্র করা যায়, কেমন খা সাহেব ?” পাঠান। আজ্ঞা হা হুজুর । বসন্ত রায় । তুমি একবার রায়গড়ে যাইয়ো । আমি যশোর হইতে ফিরিয়া গিয়া তোমার যথাসাধ্য উপকার করিব । a পাঠান উৎফুল্ল হইয়া কহিল, “আপনি ইচ্ছা করিলে কী না করিতে পারেন।” পাঠান ভাবিল একরকম বেশ গুছাইয়া লইয়াছি । জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার সেতার বাজানো আসে ?” বসন্ত রায় কহিলেন, “ই” ও তৎক্ষণাৎ সেতার তুলিয়া লইলেন । অঙ্গুলিতে মেজরাপ আঁটিয়া বেহাগ আলাপ করিতে লাগিলেন । মাঝে মাঝে পাঠান মাথা নাডিয়া বলিয়া উঠিল, “বাহবা ! খাসী !” ক্রমে উত্তেজনার প্রভাবে শিবিকার মধ্যে বসিয়া থাকা বসন্ত রায়ের পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিল । তিনি উঠিয়া দাড়াইয়া বাজাইতে লাগিলেন । মর্যাদা গাম্ভীৰ্য আত্মপর সমস্ত বিস্মৃত হইলেন ও বাজাইতে গান থামিলে পাঠান কহিল, “বাঃ, কী চমৎকার আওয়াজ ।” বসন্ত রায় কহিলেন, “তবে বোধ করি নিস্তব্ধ রাত্রে, খোলা মাঠে সকলের আওয়াজই মিঠা লাগে । কারণ, গলা অনেক সাধিয়াছি বটে কিন্তু লোকে আমার আওয়াজের তো বড়ো প্ৰশংসা করে না । তবে কি না, বিধাতা যতগুলি রোগ দিয়াছেন তাহার সকলগুলিরই একটি-না-একটি ঔষধ দিয়াছেন, তেমনি