পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী 8 ܓ2 দাদামহাশয়ের অভিসন্ধি সিদ্ধ হইল। অনেকদিনের পর প্রথম আলাপে বিভার মুখ খুলিতে কিছু আয়োজনের আবশ্যক করে, কিন্তু দাদামহাশয়ের কাছে বিভার মুখ একবার খুলিলে তাহা বন্ধ করিতে আবার ততোধিক আয়োজনের আবশ্যক হয় । কিন্তু দাদামহাশয় ব্যতীত আর কাহারও কাছে কোনো অবস্থাতেই বিভার মুখ খুলে না । বসন্ত রায় টাকে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, “সে একদিন গিয়াছে রে ভাই । যেদিন বসন্ত রায়ের মাথায় একমাথা চুল ছিল, সেদিন কি আর এত রাস্তা হাঁটিয়া তোমাদের খোেশামোদ করিতে আসিতাম ? একগাছি চুল পাকিলে তোমাদের মতো পাচটা রূপসী চুল তুলিবার জন্য উমেদার হইত ও মনের আগ্রহে দশটা কঁচা চুল তুলিয়া ফেলিত ।” বিভা গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা দাদামহাশয়, তোমার যখন একমাথা চুল ছিল, তখন কি তোমাকে এখনকার চেয়ে ভালো দেখিতে ছিল ?” মনে মনে বিভার সে-বিষয়ে বিষম সন্দেহ ছিল। দাদামহাশয়ের টাকটি, তাহার গুম্ফাসম্পর্কশ্বনা অধরের প্রশস্ত হাসিটি, তাহার। পাকা আস্রের ন্যায় ভাবটি, সে মনে মনে পরিবর্তন করিতে চেষ্টা করিল, কোনোমতেই ভালো ঠেকিল না । সে দেখিল, সে টাকটি না দিলে তাহার দাদামহাশয়কে কিছুতে মানায় না । আর গোফ জুড়িয়া দিলে দাদামহাশয়ের মুখখানি একেবারে খারাপ দেখিতে হইয়া যায় । এত খারাপ হইয়া যায় যে, সে তাহা কল্পনা করিলে হাসি রাখিতে পারে না । দাদামহাশয়ের আবার গোফ ! দাদামহাশয়ের আবার টাক নাই ! বসন্ত রায় কহিলেন, “ সে-বিষয়ে অনেক মতভেদ আছে । আমার নাতনীরা আমার টাক দেখিয়া মোহিত হয়, তাহারা আমার চুল দেখে নাই । আমার দিদিমারা আমার চুল দেখিয়া মোহিত হইতেন, তাহারা আমার টাক দেখেন নাই । যাহারা উভয়ই দেখিয়াছে, তাহার এখনো একটা মত স্থির করিতে °८ । ।।' বিভা কহিল, “কিন্তু তা বলিয়া দাদামহাশয়, যতটা টাক পড়িয়াছে তাহার অধিক পড়িলে আর ভালো দেখাইবে না ।” সুরমা কহিল, “দাদামহাশয়, টাকের আলোচনা পরে হইবে । এখন বিভার একটা যাহা হয় উপায় করিয়া দাও ।” বিভা তাড়াতাড়ি বসন্ত রায়ের কাছে গিয়া বলিয়া উঠিল, “দাদামহাশয়, আমি তোমার পাকা চুল जूलिशा निश् ।” সুরমা । আমি বলি কিবিভা । শোনো-না দাদামহাশয়, তোমার— A. সুরমা । বিভা, চুপ কর । আমি বলি কি, তুমি গিয়ে একবার— বিভা ৷ দাদামহাশয়, তোমার মাথায় পাকা চুল ছাড়া যে আর কিছুই নেই, তুলে দিলে সমস্ত মাথায় টাক পড়বে | বসন্ত রায় । আমাকে যদি কথা শুনতে না দিস দিদি, আমাকে যদি বিরক্ত করিস। তবে আমি রাগ হিন্দোল আলাপ করিব । বলিয়া তাহার ক্ষুদ্রায়তন সেতারটির কান মোচড়াইতে আরম্ভ করিলেন । হিন্দোল রাগের উপর বিভার বিশেষ বিদ্বেষ ছিল । বিভা বলিল, “কী সর্বনাশ । তবে আমি পালাই ।” বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল । তখন সুরমা গভীর হইয়া কহিল, “বিভা নীরব হইয়া দিনরাত্ৰি যে কষ্ট প্ৰাণের মধ্যে বহন করে তাহা জানিতে পারিলে বোধ করি মহারাজারও মনে দয়া হয় !” “কেন। কেন । তাহার কী হয়েছে।” বলিয়া নিতান্ত আগ্রহের সহিত বসন্ত রায় সুরমার কাছে গিয়া বসিলেন ।