পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V\OS রবীন্দ্র-রচনাবলী বিভা কহিল, “মোহন, তুই বোস ; তোদের দেশের গল্প আমায় বল!” রামমোহন বসিল । চন্দ্ৰদ্বীপের বর্ণনা করিতে লাগিল । বিভা গালে হাত দিয়া একমনে শুনিতে লাগিল । চন্দ্ৰদ্বীপের বর্ণনা শুনিতে শুনিতে তাহার হৃদয়টুকুর মধ্যে কত কী কল্পনা জাগিয়া উঠিয়াছিল, সেদিন সে আসমানের উপর কত ঘরবাড়িই বাধিয়াছিল তাহার আর ঠিকানা নাই। যখন রামমােহন গল্প করিল গত বর্ষার বন্যায় তাহার ঘরবাড়ি সমস্ত ভাসিয়া গিয়াছিল, সন্ধ্যার প্রাককালে সে একাকী তাহার বৃদ্ধ মাতাকে পিঠে করিয়া সাতার দিয়া মন্দিরের চূড়ায় উঠিয়াছিল ও দুইজনে মিলিয়া সমস্ত রাত্রি সেখানে যাপন করিয়াছিল তখন বিভার ক্ষুদ্ৰ বুকটির মধ্যে কী হৃৎকম্পই উপস্থিত হইয়াছিল । গল্প ফুরাইলে পর রামমোহন কহিল, “মা, তোমার জন্য চারগাছি শাখা আনিয়াছি, তোমাকে ঐ হাতে পরিতে হইবে, আমি দেখিব ।” বিভা তাহার চারগাছি সোনার চুড়ি খুলিয়া শাখা পরিল ও হাসিতে হাসিতে মায়ের কাছে গিয়া কহিল, “মা, মোহন তোমার চুড়ি খুলিয়া আমাকে চারগাছি শাখা পরাইয়া দিয়াছে।” মানাইয়াছে ।” রামমোহন অত্যন্ত উৎসাহিত ও গর্বিত হইয়া উঠিল । মহিষী। তাহাকে ডাকাইয়া লইয়া গেলেন, নিজে উপস্থিত থাকিয়া তাহাকে আহার করাইলেন । সে তৃপ্তিপূর্বক ভোজন করিলে পর তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “ মোহন, এইবারে তোর সেই আগমনীর গানটি গা ।” রামমোহন বিভার দিকে চাহিয়া গাহিল, “সারা বরযা দেখি নে মা, মা তুই আমার কেমনধারা, নয়নতার হারিয়ে আমার অন্ধ হল নয়নতারা । এলি কি পাষাণী ওরে, দেখিব তোরে আঁখি ভরে কিছুতেই থামে না যে মা, পোড়া এ নয়নের ধারা ।” রামমোহনের চোখে জল আসিল, মহিষীও বিভার মুখের দিকে চাহিয়া চোখের জল মুছিলেন । আগমনীর গানে তাহার বিজয়ার কথা মনে পড়িল । , ক্ৰমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল । পুরমহিলাদের জনতা বাড়িতে লাগিল । প্রতিবেশিনীরা জামাই দেখিবার জন্য ও সম্পর্ক অনুসারে জামাইকে উপহাস করিবার জন্য অন্তঃপুরে সমাগত হইল। আনন্দ, করিতেছে, তাহার মুখ-কান লাল হইয়া উঠিয়াছে, তাহার হাত-পা শীতল হইয়া গিয়াছে । ইহা কষ্ট কি সুখ কে জানে ! জামাই অন্তঃপুরে আসিয়াছেন । হুলবিশিষ্ট সৌন্দর্যের ঝাকের ন্যায় রমণীগণ চারি দিক হইতে তাহাকে আক্রমণ করিয়াছে । চারি দিকে হাসির কোলাহল উঠিল । চারি দিক হইতে কোকিল-কণ্ঠের তীব্ৰ উপহাস, মৃণাল-বাহুর কঠোর তাড়ন, চম্পক-অঙ্গুলির চন্দ্র-নখরের তীক্ষ পীড়ন চলিতে লাগিল । রামচন্দ্র রায় যখন নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িয়াছেন, তখন একজন প্রৌঢ়া রমণী আসিয়া তাহার পক্ষ অবলম্বন করিয়া বসিল । সে কঠোর কণ্ঠে এমনি কাটা কাটা কথা কহিতে লাগিল ও ক্রমেই তাহার মুখ দিয়া এমনি সকল রুচির বিকার বাহির হইতে লাগিল যে পুররমণীদের মুখ একপ্রকার বন্ধ হইয়া আসিল । তাহার মুখের কাছে থাকোদিদিও চুপ করিয়া গেলেন । বিমলাদিদি ঘর হইতে উঠিয়া চলিয়া গেলেন । কেবল ভুতোর মা তাহাকে খুব এক কথা শুনাইয়াছিল । যখন উল্লিখিত ভুতোর মার মুখ খুব চলিতেছিল, তখন সেই প্রৌঢ় তাহাকে বলিয়াছিল, “মাগো, মা, তোমার মুখ নয় তো, একগাছা বঁটা ।” ভূতোর মা তৎক্ষণাৎ কহিল, “আর মাগি, তোর মুখটা আঁস্তাকুড়, এত বঁাটাইলাম। তবুও সাফ