পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট \ტ8 ა দ্বাদশ পরিচ্ছেদ প্রতাপাদিত্য ঘুম ভাঙিয়া উচ্চস্বরে ডাকিলেন, “প্রহরী।” যখন প্রহরী আসিল না, তখন অবিলম্বে শয্যা ত্যাগ করিয়া তিনি বিদ্যুদবেগে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন । ডাকিলেন, “মন্ত্রী ।” একজন “মন্ত্রী, প্রহরীরা কোথায় গেল ?” মন্ত্রী কহিলেন, “বহিদ্বারের প্রহরীরা পলাইয়া গেছে।” মন্ত্রী দেখিলেন, মাথার উপরে বিপদ ঘনাইয়া আসিয়াছে। এই নিমিত্ত প্রতাপাদিত্যের কথার স্পষ্ট পরিষ্কার দ্রুত উত্তর দিলেন । যতই ঘুরাইয়া ও যতই বিলম্ব করিয়া তাহার কথার উত্তর দেওয়া হয়, ততই তিনি আগুন হইয়া উঠিতে থাকেন । মন্ত্রী কহিলেন, “আসিবার সময় দেখিলাম তাহারা হাত-পা বাধা পড়িয়া আছে।” মন্ত্রী রাত্রির ব্যাপার কিছুই জানিতেন না । কী হইয়াছে কিছু অনুমান করিতে পারিতেছেন না । অথচ বুঝিয়াছেন, একটা কী ঘোরতর ব্যাপার ঘটিয়াছে ; সে সময়ে মহারাজকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করা অসম্ভব । প্রতাপাদিত্য তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, “রামচন্দ্র রায় কোথায় ? উদয়াদিত্য কোথায় ? বসন্ত রায় কোথায় ?” মন্ত্রী ধীরে ধীরে কহিলেন, “ বোধ করি তাহারা অন্তঃপুরেই আছেন।” প্রতাপাদিত্য বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “ বোধ তো আমিও করিতে পারিতাম । তোমাকে জিজ্ঞাসা করিলাম কী করিতে । যাহা বোধ করা যায় তাহা সকল সময়ে সত্য হয় না ।” মন্ত্রী কিছু না বলিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন । রমাপতির কাছে রাত্রের ঘটনা সমস্তই অবগত হইলেন ; যখন শুনিলেন, রামচন্দ্র রায় পালাইয়া গেছেন, তখন তাহার বিশেষ ভাবনা উপস্থিত হইল । মন্ত্রী বাহিরে গিয়া দেখিলেন, খর্বকায় রামাই ভাড় গুড়ি মারিয়া বসিয়া আছে । মন্ত্রীকে দেখিয়া রামাই ভাড় কহিল, “এই যে মন্ত্রী জাম্ববান ।” বলিয়া দাঁত বাহির করিল। তাহার সেই দন্তপ্রধান হাস্যকে রামচন্দ্রের সভাসদেরা রসিকতা বলিত, বিভীষিকা বলিত না । মন্ত্রী তাহার সাদর সম্ভাষণ শুনিয়া কিছুই বলিলেন না, তাহার প্রতি দৃকপাতও করিলেন না। একজন ভৃত্যকে কহিলেন, “ইহাকে লাইয়া আয় ।” মন্ত্রী ভাবিলেন, এই অপদার্থটাকে এই বেলা প্রতাপাদিত্যের ক্ৰোধের সামনে খাড়া করিয়া দিই। "| প্রতাপাদিত্যের বীজ একজন-না- একজনের উপরে পড়িবেই— তা এই কলাগাছটার রমাইকে দেখিয়াই প্রতাপাদিত্য একেবারে জুলিয়া উঠিলেন । বিশেষত সে যখন প্রতাপাদিত্যকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য দাত বাহির করিয়া, অঙ্গভঙ্গি করিয়া একটা হাস্যরসের কথা কহিবার উপক্রম করিল, তখন প্রতাপাদিত্যের আর সহ্য হইল না । তিনি অবিলম্বে আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দুই হাত নাড়িয়া দারুণ ঘূণায় বলিয়া উঠিলেন, “দূর করো, দূর করো, উহাকে এখনই দূর করিয়া দাও। ওটাকে আমার সম্মুখে আনিতে কে কহিল ?” প্রতাপাদিত্যের রাগের সহিত যদি ঘূণার উদয় না হইত, তবে রামাই ভঁাড় এ-যাত্ৰা পরিত্রাণ পাইত না । কেননা ঘূণ্য ব্যক্তিকে প্রহার করিতে গেলেও স্পর্শ করিতে হয় । রমাইকে তৎক্ষণাৎ বাহির করিয়া দেওয়া হইল । প্রতাপাদিত্য অধীর ভাবে মাথা নাডিয়া কহিলেন, “রামচন্দ্র রায়-” মন্ত্রী কহিলেন, “হা, তিনি কাল রাত্রে রাজপুরী পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন।” । প্রতাপাদিত্য দাড়াইয়া উঠিয়া কহিলেন, “পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন ? প্রহরীরা গেল কোথায় ?” মন্ত্রী পুনরায় কহিলেন, “বহিৰ্দ্ধারের প্রহরীরা পালাইয়া গেছে।” প্রতাপাদিত্য মুষ্টিবদ্ধ করিয়া কহিলেন, “পালাইয়া গেছে ? পালাইবে কোথায় ? যেখানে থাকে Sliss