পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ܓ 8ܟܠ মুকু খুজিয়া আনিতে হইবে। অন্তঃপুরের প্রহরীদের এখনই ডাকিয়া লইয়া এসাে।” মন্ত্রী বারি হয়া গেলেন । রামচন্দ্র রায় যখন নীেকায় চড়িলেন তখনো অন্ধকার আছে। উদয়াদিত্য, বসন্ত রায়, সুরমা ও বিভা সে-রাত্ৰে আসিয়া আর বিছানায় শুইল না । বিভা একটি কথা না বলিয়া, একটি অশ্রু না ফেলিয়া অবসন্নভাবে শুইয়া রহিল, সুরমা তাহার কাছে বসিয়া তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল । উদয়াদিত্য ও বসন্ত রায় চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন । অন্ধকার ঘরে পরস্পরের মুখ অস্পষ্টভাবে দেখা যাইতেছে। ঘরের মধ্যে যেন অদৃশ্য একজন কো— অন্ধকার বল, আশঙ্কা বল, অদৃষ্ট বল— বসিয়া আছে, তাহার নিশ্বাস-পতনের শব্দ শুনা যাইতেছে । সদানন্দ-হৃদয় বসন্ত রায় চারি দিকে নিরানন্দ দেখিয়া একেবারে আকুল হইয়া পড়িয়াছেন । তিনি অনবরত টাকে হাত বুলাইতেছেন, চারি দিক দেখিতেছেন, ও ভাবিতেছেন- এ কী হইল । তাহার গোলমাল ঠেকিয়াছে, চারি দিককার ব্যাপার ভালোরূপ আয়ত্ত করিতে পারিতেছেন না । সমস্ত ঘটনা তাহার একটা জটিল দুঃস্বপ্ন বলিয়া মনে হইতেছে । এক-একবার বসন্ত রায় উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া কাতর স্বরে কহিতেছেন, “দাদা ।” উদয়াদিত্য কহিতেছেন, “কী দাদামহাশয় ?” তাহার উত্তরে বসন্ত রায়ের আর কথা নাই । ঐ এক “দাদা” সম্বোধনের মধ্যে একটি আকুল দিশাহারা হৃদয়ের বাক্যহীন সহস্ৰ অব্যক্ত প্রশ্ন প্ৰকাশ পাইবার জন্য আঁকুৰ্বাকু করিতেছে। তাহার বিশেষ একটা কোনো প্রশ্ন নাই, তাহার সমস্ত কথার অর্থ এই— এ কী ? চারি দিককার অন্ধকার এমনি গোলমাল করিয়া একটা কী ভাষায় তাহার কানের কাছে কথা কহিতেছে, তিনি কিছুই বুঝিতে পারিতেছেন না । এমন সময়ে উদয়াদিত্যের সাড়া পাইলেও তাহার মনটা একটু স্থির হয় । থাকিয়া থাকিয়া তিনি সকাতরে উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া কহিলেন, “দাদা, আমার জন্যই কি এ-সমস্ত হইল ?” তাহার বার বার মনে হইতেছে তাহাকে বিনাশ করিতে না পারাতেই এই-সমস্ত ঘটিয়াছে | উদয়াদিত্যের তখন অধিক কথা কহিবার মতো ভাব নহে । তিনি কোমল স্বরে কহিলেন, “না দাদামহাশয় ।” অনেকক্ষণ ঘর নিস্তব্ধ হইয়া রহিল । থাকিয়া থাকিয়া বসন্ত রায় আবার বলিয়া উঠিলেন, “বিভা, দিদি আমার, তুই কথা কহিতেছিস না কেন ?” বলিয়া বসন্ত রায় বিভার কাছে গিয়া বসিলেন । কিছুক্ষণ পরে বসন্ত রায় আবার বলিয়া উঠিলেন, “সুরমা, ও সুরমা !" সুরমা মুখ তুলিয়া চাহিল, আর কিছু বলিল না । বৃদ্ধ বসিয়া বসিয়া মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন । একটা অনিৰ্দেশ্য বিপদের প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন । সুরমা তখন স্থিরভাবে বসিয়া বিভার কপালে হাত বুলাইতেছিল, কিন্তু সুরমার হৃদয়ে যাহা হইতেছিল, তাহা অন্তর্যামীই দেখিতেছিলেন । সুরমা সেই অন্ধকারে একবার উদয়াদিত্যের মুখের দিকে চাহিল। তখন উদয়াদিত্য দেয়ালে মাথা রাখিয়া একমনে কী ভাবিতেছিলেন । সুরমার দুই চক্ষু বাহিয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল । আস্তে আস্তে মুছিয়া ফেলিল পাছে বিভা জানিতে পায় । যখন চারি দিক আলো হইয়া আসিল তখন বসন্ত রায় নিশ্বাস ফেলিয়া বঁচিলেন । তখন তাহার। মন হইতে একটা অনিৰ্দেশ্য আশঙ্কার ভাব দূর হইল। তখন স্থিরচিত্তে সমস্ত ঘটনা একবার আলোচনা করিয়া দেখিলেন । তিনি বিভার ঘর হইতে উঠিয়া গেলেন । অন্তঃপুরের দ্বারে হাত-পা-বাধা সীতারামের কাছে গিয়া উপস্থিত হইলেন । তাহাকে কহিলেন, “দেখ সীতারাম, তোকে যখন প্রতাপ জিজ্ঞাসা করিবে, কে তোকে বাধিয়াছে, তুই আমার নাম করিস। প্ৰতাপ জানে, এককালে বসন্ত রায় বলিষ্ঠ ছিল, সে তোর কথা বিশ্বাস করিবে ।” সীতারাম প্রতাপাদিত্যের কাছে কী জবাব দিবে, এতক্ষণ ধরিয়া তাহাই ভাবিতেছিল । এ সম্বন্ধে উদয়াদিত্যের নাম করিতে কোনোমতেই তাহার মন উঠিতেছিল না । সে একটা বাকা-পা তিন-চোখো তালবৃক্ষাকৃতি ভূতকে আসামী করিবে বলিয়া একবার স্থির করিয়াছিল, কিন্তু বসন্ত রায়কে পাইয়া নিরপরাধ ভূতটাকে খালাস দিল । বসন্ত রায়ের কথায় সে তৎক্ষণাৎ রাজি হইল। তখন তিনি দ্বিতীয় প্রহরীর নিকট গিয়া কহিলেন, “ভাগবত, প্ৰতাপ জিজ্ঞাসা করিলে বলিয়ো বসন্ত রায় তোমাকে বাধিয়াছে।” সহসা ভাগবতের ধর্মজ্ঞান অত্যন্ত প্রবল হইয়া উঠিল, অসত্যের প্রতি নিতান্ত বিরাগ