পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ88 রবীন্দ্র-রচনাবলী তিনি উদয়াদিত্যকে সম্মুখে রাখিয়াই ভৎসনা করিতেছেন। বসন্ত রায়ের অপরাধ, তিনি উদয়াদিত্যকে প্ৰাণের অধিক ভালোবাসেন । বসন্ত রায় তাড়াতাড়ি কহিয়া উঠিলেন, “বাবা প্ৰতাপ, উদয়ের ইহাতে কোনো দোষ নাই ।” প্রতাপাদিত্য আগুন হইয়া কহিলেন, “দোষ নাই ? তুমি দোষ নাই বলিতেছ। বলিয়াই তাহাকে বিশেষরূপে শাস্তি দিব । তুমি মাঝে পড়িয়া মীমাংসা করিতে আসিয়াছ কেন ?” বসন্ত রায় অত করিয়া উদয়াদিত্যের পক্ষ লইয়াছেন বলিয়াই প্রতাপাদিত্যের মন উদয়াদিত্যের বিশেষ বিপক্ষ হইয়া দাড়াইল । বসন্ত রায় দেখিলেন, তাহাকে শাস্তি দিবার জন্যই পাছে উদয়াদিত্যকে শাস্তি দেওয়া হয় । চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন । কিয়ৎক্ষণ পরে শান্ত হইয়া প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “যদি জানিতাম উদয়াদিত্যের কিছুমাত্র নিজের মনের জোর আছে, তাহার একটা মত আছে, একটা অভিপ্ৰায় আছে, যাহা করে, সব নিজে হইতেই কবে, যদি না জানিতাম যে সে-নির্বোধিটাকে যে খুশি ফু দিয়া উড়াইয়া বেড়াইতে পারে, কটাক্ষের সংকেতে ঘুরাইয়া মারিতে পারে তাহা হইলে তাহার আজ আর রক্ষা ছিল না । আমি যেখানে ঐ পালকাটাকে উড়িতে দেখিয়াছি, নীচের দিকে চাহিয়া দেখিয়াছি ফু দিতেছে কে । এইজন্য উদয়াদিত্যকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করে না । সে শাস্তিরও অযোগ্য । কিন্তু শোনো পিতৃব্যঠাকুর, তুমি যদি দ্বিতীয়বার যশোহরে আসিয়া উদয়াদিত্যের সহিত দেখা কর তবে তাহার প্রাণ বাচানো দায় হইবে ।” বসন্ত রায় অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন ; পরে ধীরে ধীরে উঠিয়া কহিলেন, “ভালো প্ৰতাপ, আজি সন্ধ্যাবেলায়। তবে আমি চলিলাম।” আর একটি কথা না বলিয়া বসন্ত রায় ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন, বাহির হইয়া গিয়া গভীর এক নিশ্বাস ফেলিলেন । প্রতাপাদিত্য স্থির করিয়াছেন, যে-কেহ উদয়াদিত্যকে ভালোবাসে, উদয়াদিত্য যাহাদের বশীভূত তাহাদিগকে উদয়াদিত্যের নিকট হইতে তফাত করিতে হইবে । মন্ত্রীকে কহিলেন, “বউমাকে আর রাজপুরীতে থাকিতে দেওয়া হইবে না, কোনো সূত্রে তাহাকে তাহার বাপের বাড়ি পাঠাইতে হইবে ।” বিভার প্রতি প্রতাপাদিত্যের কোনো আশঙ্কা হয় নাই ; হাজার হউক, সে বাড়ির মেয়ে । ত্ৰয়োদশ পরিচ্ছেদ বসন্ত রায় উদয়াদিত্যের ঘরে আসিয়া কহিলেন, “দাদা, তোর সঙ্গে আর দেখা হইবে না ।” বলিয়া উদয়াদিত্যকে বৃদ্ধ দুই হাতে জড়াইয়া ধরিলেন । উদয়াদিত্য বসন্ত রায়ের হাত ধরিয়া কহিলেন, “কেন দাদামহাশয় ?” বসন্তরায় সমস্ত বলিলেন । কঁাদিয়া কহিলেন, “ভাই, তোকে আমি ভালোবাসি বলিয়াই তোর এত দুঃখ । তা তুই যদি সুখে থাকিস তো এ-কটা দিন আমি একরকম কাটাইয়া দিব ।” উদয়াদিত্য মাথা নাডিয়া কহিলেন, “না, তাহা কখনোই হইবে না । তোমাতে আমাতে দেখা হইবেই। তাহাতে কেহ বাধা দিতে পরিবে না । তুমি গেলে দাদামহাশয়, আমি আর বাচিব না ।” বসন্ত রায় ব্যাকুল হইয়া কহিলেন, “প্ৰতাপ আমাকে বধ করিল না, তোকে আমার কাছ হইতে কড়িয়া লইল ! দাদা, আমি যখন চলিয়া যাইব, আমার পানে ফিরিয়া চাহিস নে, মনে করিস বসন্ত রায় মরিয়া গেল ।” উদয়াদিত্য শয়নকক্ষে সুরমার নিকটে গেলেন । বসন্ত রায় বিভার কাছে গিয়া বিভার চিবুক ধরিয়া কহিলেন, “বিভা, দিদি আমার, একবার ওঠ । বুড়ার এই মাথাটায় একবার ঐ হাত বুলাইয়া দে {” বিভা উঠিয়া বসিয়া দাদামহাশয়ের মাথা লইয়া পাকা চুল তুলিয়া দিতে লাগিল । উদয়াদিত্য সুরমাকে সমস্ত কহিলেন ও বলিলেন, “সুরমা, পৃথিবীতে আমার যাহা-কিছু অবশিষ্ট আছে তাহাই কড়িয়া লইবার জন্য যেন একটা যড়যন্ত্র চলিতেছে।” সুরমার হাত ধরিয়া কহিলেন, “সুরমা, তোমাকে যদি কেহ আমার কাছ হইতে ছিনিয়া লইয়া যায় ?”