পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8 Ve রবীন্দ্র-রচনাবলী নাম ধরে আর ডাকিস নে ভাই, যেতে হবে ত্বরা করে । “ঐ দেখো, ঐ দেখো বিভার রকম দেখো । দেখা বিভা, তুই যদি আমন করিয়া কাদিবি তো—“ বলিতে বলিতে বসন্ত রায়ের আর কথা বাহির হইল না । তিনি বিভাকে শাসন করিতে গিয়া নিজেকে আর সামলাইতে পারিলেন না, তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া হাসিয়া কহিলেন, “দাদা, ঐ দেখো ভাই, সুরমা কঁাদিতেছে। এই বেলা ইহার প্রতিবিধান করো ; নহিলে আমি সত্য সত্যই থাকিয়া যাইব, তোমার জায়গাটি দখল করিয়া বসিব । ঐ দুই হাতে পাকা চুল তোলাইব, ঐ ক্যানের কাছে এই ভাঙা দাতের পাটির মধ্য হইতে ফিসফিস করিব, আর কানের অত কাছে গিয়া আর যদি কোনোপ্রকার অঘটন সংঘটন হয় তবে তাহার দায়ী আমি হইব না ।” বসন্ত রায় দেখিলেন, কেহ কোনো কথা কহিল না, তখন তিনি কাতর হইয়া তাহার সেতারটা তুলিয়া লইয়া ঝনঝন করিয়া বিষম বেগে বাজাইতে শুরু করিলেন । কিন্তু বিভার চােখের জল দেখিয়া তঁহার সেতার বাজাইবার বড়োই ব্যাঘাত হইতে লাগিল, তাহার চোখ মাঝে মাঝে ঝাপসা হইয়া আসিতে লাগিল, মাঝে মাঝে বিভাকে এবং উপস্থিত সকলকে তিরস্কারচ্ছলে রাশি রাশ কথা বলিবার বাসনা হইতে লাগিল, কিন্তু আর কথা জোগাইল না, কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল, সেতার বন্ধ করিয়া নামাইয়া রাখিতে হইল । অবশেষে বিদায়ের সময় আসিল । উদয়াদিত্যকে দীর্ঘকাল আলিঙ্গন করিয়া শেষ কথা এই বলিয়া গেলেন, “এই সেতার রাখিয়া গেলাম দাদা, আর সেতার বাজাইব না । সুরমা ভাই সুখে থাকো ; বিভা—” কথা শেষ হইল না, অশ্রু মুছিয়া পালকিতে উঠিলেন । চতুৰ্দশ পরিচ্ছেদ মঙ্গলার কুটির যশোহরের এক প্রান্তে ছিল । সেইখানে বসিয়া সে মালা জপ করিতেছিল । এমন সময়ে শাকসবজির চুবড়ি হাতে করিয়া রাজবাটীর দাসী মাতঙ্গিনী আসিয়া উপস্থিত হইল । তা একবার দেখিয়া আসি গে । আজ ভাই অনেক কাজ আছে, অধিকক্ষণ থাকিতে পারিব না ।” বলিয়া চুবড়ি রাখিয়া নিশ্চিন্তভাবে সেইখানে বসিল । “তা দিদি, তুমি তো সব জােনই, সেই মিনসে আমাকে বড়ো ভালোবাসিত, ভালো এখনো বাসে তবে আর-একজন কার পরে তার মন গিয়াছে আমি টের পাইয়াছি- তা সেই মাগীটার ত্রিরাত্রির মধ্যে মরণ হয় এমন করিতে পার না ?” মঙ্গলার নিকট গোরু, হারানো হইতে স্বামী হারানো পর্যন্ত সকলপ্রকার দুর্ঘটনারই ঔষধ আছে, তা ছাড়া সে বশীকরণের এমন উপায় জানে যে, রাজবাটীর বড়ো বড়ো ভৃত্য মঙ্গলার কুটিরে কত গণ্ডা গণ্ড গড়াগড়ি যায়। যে-মাগীিটার ত্রিরাত্রির মধ্যে মরণ হইলে মাতঙ্গিনী বঁাচে সে আর কেহ নহে স্বয়ং মঙ্গলা । মঙ্গলা মনে মনে হাসিয়া কহিল, “সে মাগীর মরিবার জন্য বড়ো তাড়াতাড়ি পড়ে নাই, যমের কাজ বাড়াইয়া। তবে সে মরিবে ।” মঙ্গলা হাসিয়া প্রকাশ্যে কহিল, “তোমার মতন রূপসীকে ফেলিয়া আর কোথাও মন যায় এমন অরসিক আছে নাকি ? তা নাতিনী, তোমার ভাবনা নাই । তাহার মন তুমি ফিরিয়া পাইবে । তোমার চোখের মধ্যেই ঔষধ আছে, একটু বেশি করিয়া প্রয়োগ করিয়া দেখিয়ো, তাহাতেও যদি না হয় তবে এই শিকড়টি তাহাকে পানের সঙ্গে খাওয়াইয়ো ।” বলিয়া এক শুকনো শিকড় আনিয়া দিল ।