পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V9VV9 রবীন্দ্র-রচনাবলী মহারাজের কাছে গিয়া সমস্ত কহিলেন । মহারাজ প্রশান্তভাবে কহিলেন, “তা বেশ তো, বিভার যদি ইচ্ছা না হয় তো কেন যাইবে ?” মহিষী অবাক হইয়া, হাত উলটাইয়া, হাল ছাড়িয়া দিয়া কহিলেন, “তোমাদের যাহা ইচ্ছা তাহাঁই করো, আমি আর কোনো কথায় থাকিব না ।” উদয়াদিত্য সমস্ত শুনিয়া বিস্মিত হইলেন। তিনি বিভাকে আসিয়া অনেক করিয়া বুঝাইলেন। বিভা চুপ করিয়া কঁদিতে লাগিল, ভালো বুঝিল না । হতাশ্বাস রামমোহন আসিয়া স্নানমুখে কহিল, “মা, তবে চলিলাম। মহারাজকে গিয়া কী বলিব ।” বিভা কিছু বলিতে পারিল না, অনেকক্ষণ নিরুত্তর হইয়া রহিল। রামমোহন কহিল, “তবে বিদায় হই মা ।” বলিয়া প্ৰণাম করিয়া উঠিয়া গেল । বিভা একেবারে আকুল হইয়া কঁদিয়া উঠিল, কাতর স্বরে ডাকিল, “মোহন ৷” মোহন ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “কী মা ?” বিভা কহিল, “মহারাজকে বলিয়ো, আমাকে যেন মার্জনা করেন। তিনি স্বয়ং ডাকিতেছেন, তবু আমি যাইতে পারিলাম না, সে কেবল নিতান্তই আমার দূরদৃষ্ট ।” রামমোহন শুষ্কভাবে কহিল, “ যে আজ্ঞা ।” রামমোহন আবার প্রণাম করিয়া বিদায় হইয়া গেল। বিভা দেখিল, রামমোহন বিভার ভাব কিছুই বুঝিতে পারে নাই, তাহার ভারি গোলমাল ঠেকিয়াছে। একে তো বিভার প্রাণ যেখানে যাইতে চায়, বিভা সেখানে যাইতে পারিল না । তাহার উপর রামমোহন, যাহাকে সে যথার্থ স্নেহ করে, সে আজ রাগ করিয়া চলিয়া গেল । বিভার প্রাণে যাহা হইল তাহা বিভাই জানে । বিভা রহিল। চোখের জল মুছিয়া প্ৰাণের মধ্যে পাষণভার বহিয়া সে তাহার দাদার কাছে পড়িয়া রহিল । স্নান শীর্ণ একখানি ছায়ার মতো সে নীরবে সমস্ত ঘরের কাজ করে । উদয়াদিত্য স্নেহ করিয়া আদর করিয়া কোনো কথা কহিলে চোখ নিচু করিয়া একটুখানি হাসে । সন্ধ্যাবেলায় উদয়াদিত্যের পায়ের কাছে বসিয়া একটু কথা কহিতে চেষ্টা করে ; যখন মহিষী তিরস্কার করিয়া কিছু বলেন, চুপ করিয়া দাড়াইয়া শোনে ও অবশেষে একখণ্ড মলিন মেঘের মতো ভাসিয়া চলিয়া যায় ; যখন কেহ বিভার চিবুক ধরিয়া বলে “বিভা, তুই এত রোগ হইতেছিস কেন” বিভা কিছু বলে না, কেবল একটু হাসে । এই সময়ে ভাগবত পূর্বোক্ত জাল দরখাস্তটি লইয়া প্রতাপাদিত্যকে দেখায়। প্রতাপাদিত্য আগুন হইয়া উঠিলেন, পরে অনেক বিবেচনা করিয়া উদয়াদিত্যকে কারারুদ্ধ করিবার আদেশ দিলেন । মন্ত্রী কহিলেন, “মহারাজ, যুবরাজ যে এ কাজ করিয়াছেন, ইহা কোনোমতেই বিশ্বাস হয় না । যে শোনে সেই জিভ কাটিয়া বলে, ও কথা কানে আনিতে নাই। যুবরাজ এ কাজ করিবেন ইহা বিশ্বাসযোগ্য নহে ।” প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “আমারও তো বড়ো একটা বিশ্বাস হয় না । কিন্তু তাই বলিয়া কারাগারে থাকিতে দোষ কী ? সেখানে কোনোপ্রকার কষ্ট না দিলেই হইল। কেবল গোপনে কিছু না করিতে পারে, তাহার জন্য পাহারা নিযুক্ত থাকিবে ।” চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ যখন রামমোহন চন্দ্ৰদ্বীপে ফিরিয়া গিয়া একাকী জোড়হন্তে অপরাধীর মতো রাজার সম্মুখে গিয়া দাড়াইল তখন রামচন্দ্র রায়ের সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া উঠিল । তিনি স্থির করিয়াছিলেন বিভা আসিলে পর তাহাকে প্রতাপাদিত্য ও তাহার বংশ সম্বন্ধে খুব দু-চারিটা খরধার কথা শুনাইয়া তাহার শ্বশুরের উপর শোধ তুলিবেন । কী কী কথা বলিবেন, কেমন করিয়া বলিবেন, কখন বলিবেন, সমস্ত তিনি মনে মনে স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন । রামচন্দ্র রায় গোয়ার নহেন, বিভাকে যে কোনোপ্রকারে পীড়ন করিবেন। ইহা তাহার অভিপ্ৰায় ছিল না। কেবল বিভাকে তাহার পিতার সম্বন্ধে মাঝে মাঝে খুব লজ্জা দিবেন।