পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট ۹ واوا এই আনন্দেই তিনি অধীর ছিলেন । এমন-কি, এই আনন্দের প্রভাবে তাহার মনেই হয় নাই যে, বিভার আসিবার পক্ষে কোনো বাধা থাকিতে পারে । এমন সময়ে রামমোহনকে একাকী আসিতে দেখিয়া রামচন্দ্র রায় নিতান্ত বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “কী হইল রামমোহন ?” রাজা চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, “আনিতে পারিলি না ?” রামমোহন । আজ্ঞা, না মহারাজ ! কুলগ্নে যাত্ৰা করিয়াছিলাম । রাজা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বেটা তোকে যাত্ৰা করিতে কে বলিয়াছিল ? তখন তোকে বার বার করিয়া বারণ করিলাম, তখন যে তুই বুক ফুলাইয়া গেলি, আর আজ-” রামমোহন কপালে হাত দিয়া স্নানমুখে কহিল, “মহারাজ, আমার অদৃষ্টের দোষ।” রামচন্দ্র রায় আরো ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “রামচন্দ্র রায়ের অপমান ! তুই বেটা আমার নাম করিয়া ভিক্ষা চাহিতে গেলি, আর প্রতাপাদিত্য দিল না । এত বড়ো অপমান আমাদের বংশে আর কখনো হয় নাই ।” তখন রামমোহন নতশির তুলিয়া ঈষৎ গর্বিতভাবে কহিল, “ও কথা বলিবেন না। প্রতাপাদিত্য যদি না দিত, আমি কাডিয়া আনিতাম । আপনার কাছে তাহা তো বলিয়াই গিয়াছিলাম। মহারাজ, যখন আপনার আদেশ পালন করিতে যাই, তখন কি আর প্রতাপাদিত্যকে ভয় করি ? প্রতাপাদিত্য রাজা বটে, কিন্তু আমার রাজা তো সে নয় ।” রাজা কহিলেন, “তবে হইল না কেন ?” রামমোহন অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, তাহার চােখে জল দেখা দিল । রাজা অধীর হইয়া কহিলেন, “রামমোহন, শীঘ্ৰ বল ?” রামমোহন জোড়হাতে কহিল, “মহারাজ-” রামমোহন । মহারাজ, মা-ঠাকরুন আসিতে চাহিলেন না । বলিয়া রামমোহনের চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল । বুঝি এ সন্তানের অভিমানের অশ্রু । বোধ করি এ অশ্রুজালের অর্থ- “মায়ের প্রতি আমার এত বিশ্বাস ছিল যে, সেই বিশ্বাসের জোরে আমি বুক ফুলাইয়া আনন্দ করিয়া মাকে আনিতে গেলাম, আর মা আসিলেন না, মা আমার সম্মান রাখিলেন না। কী জানি কী মনে করিয়া বৃদ্ধ রামমোহন চােখের জল সামলাইতে পারিল না । রাজা কথাটা শুনিয়াই একেবারে দাড়াইয়া উঠিয়া চোখ পাকাইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বটে ।” অনেকক্ষণ পর্যন্ত র্তাহার আর বাক্যস্ফুর্তি হইল না । “আসিতে চাহিলেন না ! বাটে ! বেটা, তুই বেরো, বেরো, আমার সম্মুখ হইতে এখনই বেরো ।” রামমোহন একটি কথা না কহিয়া বাহির হইয়া গেল । সে জানিত তাহারই সমস্ত দোষ, অতএব সমুচিত দণ্ড পাওয়া কিছু অন্যায় নহে। রাজা কী করিয়া যে ইহার শোধ তুলিবেন কিছুতেই ভাবিয়া পাইলেন না। প্রতাপাদিত্যের কিছু করিতে পরিবেন না, বিভাকেও হাতের কাছে পাইতেছেন না। রামচন্দ্র রায় অধীর হইয়া বেড়াইতে লাগিলেন । . দিন-দুয়েকের মধ্যে সংবাদটা নানা আকারে নানা দিকে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। এমন অবস্থা হইয়া দাড়াইল যে, প্রতিশোধ না লইলে আর মুখ রক্ষা হয় না। এমন-কি, প্রজারা পর্যন্ত প্রতিশোধ লইবার জন্য ব্যস্ত হইল। তাহারা কহিল, “আমাদের মহারাজার অপমান !” অপমানটা যেন সকলের গায়ে লাগিয়াছে। একে তো প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তি রামচন্দ্র রায়ের মনে স্বভাবতই বলবান আছে, তাহার উপরে তাহার মনে হইতে লাগিল, প্রতিহিংসা না লইলে প্রজারা কী মনে করিবে, ভূত্যেরা কী মনে করিবে, রামাই ভীড় কী মনে করিবে ? তিনি যখন কল্পনায় মনে করেন, এই কথা লইয়া রামাই আর-একজন ব্যক্তির কাছে হাসি-টিটকারি করিতেছে তখন তিনি অত্যন্ত অস্থির হইয়া পড়েন ।