পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७४२ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী চিঠিখানি রাখিয়া বাকি পত্ৰখানি নষ্ট করিয়া ফেলিল । , তখন আগুন আরো ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে। রাত্ৰে শয্যা হইতে উঠিয়া কৌতুক দেখিবার জন্য অনেক লোক জড়ো হইয়াছে। তাহাতে নির্বাণের ব্যাঘাত হইতেছে বৈ সুবিধা হইতেছে না । এই অগ্নিকাণ্ডে যে সীতারামের হাত ছিল, তাহা বলাই বাহুল্য । উদয়াদিত্যের প্রতি আসক্ত কয়েকজন প্রজা ও প্রাসাদের ভূত্যের সাহায্যে সে-ই এই কীর্তি করিয়াছে। সন্ধ্যাবেলায় একেবারে পাচ-ছয়টা ঘরে যে বিনা কারণে আগুন ধরিয়া উঠিল, ইহা কখনো দৈবের কর্ম নহে, এতক্ষণ এত চেষ্টা করিয়া আগুন নিবিয়াও যে নিবিতেছে না, তাহারও কারণ আছে। যাহারা আগুন নিবাইতে যোগ দিয়াছে, তাহাদের মধ্যেই দুই-একজন করিয়া সীতারামের লোক আছে। যেখানে আগুন নাই তাহারা সেইখানে জল ঢালে, জল আনিতে গিয়া আনে না, কৌশলে কলসী ভাঙিয়া ফেলে, গোলমাল কবিয়া এ ওর ঘাড়ের উপর গিয়া পড়ে । আগুন আর নেবে না । এ দিকে যখন এইরূপ গোলযোগ চলিতেছে, তখন সীতারামের দলস্থ লোকেরা উদয়াদিত্যের শনা কারাগারে আগুন লােগাইয়া দিল । একে একে জানালা দরজা কড়ি-বরগা চৌকাঠ কাঠের বেড়া প্রভৃতিতে আগুন ধরাইয়া দিল । সেই কারাগৃহে যে কোনো সূত্রে আগুন ধরিতে পারে, ইহা সকলেব স্বপ্নেরও অগোচর, সুতরাং সে দিকে আর কাহারও মনোযোগ পড়ে নাই | সীতারাম ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, আগুন বেশ রীতিমত ধরিয়াছে। কতকগুলো হাড়, মড়ার মাথা ও উদয়াদিত্যের তলোয়ারটি সীতারাম কোনোপ্রকারে উদয়াদিত্যের সেই ঘরের মধ্যে ফেলিয়া দিল । এ দিকে যাহারা প্রহরীশালার আগুন নিবাইতেছিল, কারাগারের দিক হইতে সহসা তাহারা এক চীৎকার শুনিতে পাইল । সকলে চমকিয়া একবাক্যে বলিয়া উঠিল, “ও কী রে ।” একজন ছুটিয়া আসিয়া কহিল, “ওরে, যুবরাজের ঘরে আগুন ধরিয়াছে।” প্রহরীদের রক্ত জল হইয়া গেল, দয়াল সিংহের মাথা ঘুরিয়া গেল। কলসী হাত হইতে পড়িয়া গেল, জিনিসপত্র ভূমিতে ফেলিয়া দিল। এমন সময়ে আর-একজন সেই দিক হইতে ছুটিয়া আসিয়া কহিল, “কারাগৃহের মধ্য হইতে যুবরাজ চীৎকার করিতেছেন শুনা গেল।” তাহার কথা শেষ হইতে না হইতেই সীতারাম ছুটিয়া আসিয়া কহিল, “ওরে তোরা শীঘ্ৰ আয় । যুবরাজের ঘরের ছাদ ভাঙিয়া পড়িয়াছে, আর তো তাহার সাড়া পাওয়া যাইতেছে না ।” যুবরাজের কারাগুহের দিকে সকলে ছুটিল। গিয়া দেখিল গৃহ ভাঙিয়া পড়িয়ছে- চারি দিকে আগুন— ঘরে প্রবেশ করিবার উপায় নাই । তখন সেইখানে দাড়াইয়া পরস্পর পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করিতে লাগিল । কাহার অসাবধানতায় এই ঘটনাটি ঘটিল, সকলেই তাহা স্থির করিতে প্ৰবৃত্ত হইল । ঘোরতর বিবাদ বাধিয়া উঠিল, পরস্পর পরস্পরকে গালাগালি দিতে লাগিল। এমন-কি, মারামারি হইবার উপক্রম হইল । সীতারাম ভাবিল, গৃহদাহে যুবরাজের মৃত্যু হইয়াছে, এই সংবাদ রাষ্ট্র করিয়া আপাতত কিছুদিন নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিব । যখন সে দেখিল, ঘরে বেশ করিয়া আগুন লাগিয়াছে, তখন সে মাথায় চাদর বাধিয়া আনন্দমনে তাহার কুটিরাভিমুখে চলিল। প্রাসাদ হইতে অনেক দূরে আসিল । তখন রাত্রি অনেক, পথে লোক নাই, চারি দিক স্তব্ধ । বাশ গাছের পাতা ঝর ঝর করিয়া মাঝে মাঝে দক্ষিণ বাতাস বহিতেছে, সীতারামের শৌখিন প্ৰাণ উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছে, সে একটি রসগর্ভ গান ধরিয়াছে। সেই জনশূন্য স্তব্ধ পথ দিয়া একাকী পান্থ মনের উল্লাসে গান গাহিতে গাহিতে চলিল । কিছুদূর গিয়া তাহার মনের মধ্যে এক ভাবনা উপস্থিত হইল । সে ভাবিল, যশোহর হইতে তো সপরিবারে পলাইতেই হইবে, অমনি বিনা মেহনতে কিঞ্চিৎ টাকার সংস্থান করিয়া লওয়া যাক-না ! মঙ্গলা পােড়ামুখী তো মরিয়াছে, বালাই গিয়াছে, একবার তাহার বাড়ি হইয়া যাওয়া যাক। বেটির টাকা আছে ঢের, তাহার ত্রিসংসারে কেহই নাই, সে-টাকা আমি না লই তো আর-একজন লাইবে- তায় কাজ কী, একবার চেষ্টা করিয়া দেখা যাক । এইরূপ সাত-পাচ ভাবিয়া সীতারাম রুক্সিণীর বাড়ির মুখে চলিল, প্ৰফুল্লমনে আবার গান ধরিল। যাইতে যাইতে পথে একজন অভিসারিণীকে দেখিতে পাইল । সীতারামের নজরে এ-সকল কিছুতেই এড়াইতে পায় না। দুইটা রসিকতা করিবার জন্য তাহার মনে