পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Գ ՏՏ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ নক্ষত্ররায় চলিয়া গেলে জয়সিংহ কহিলেন, “গুরুদেব, এমন ভয়ানক কথা কখনো শুনি নাই । আপনি মায়ের সম্মুখে মায়ের নাম করিয়া ভাইকে দিয়া ভ্ৰাতৃহত্যার প্রস্তাব করিলেন, আর আমাকে তাই দাড়াইয়া শুনিতে হইল।” রঘুপতি বলিলেন, “আর কী উপায় আছে বলে ।” জয়সিংহ কহিলেন, “উপায় ! কিসের উপায় ।” রঘুপতি । তুমিও যে নক্ষত্ররায়ের মতো হইলে দেখিতেছি। এতক্ষণ। তবে কী শুনিলে ? জয়সিংহ । যাহা শুনিলাম তাহা শুনিবার যোগ্য নহে, তাহা শুনিলে পাপ আছে । রঘুপতি। পাপপুণ্যের তুমি কী বুঝ ? জয়সিংহ। এতকাল আপনার কাছে শিক্ষা পাইলাম, পাপপুণ্যের কিছুই বুঝি না কি ? রঘুপতি। শোনাে বৎস, তোমাকে তবে আর-এক শিক্ষা দিই। পাপপুণ্য কিছুই নাই। কেই বা পিতা, কেই বা ভ্ৰাতা, কেই বা কে ? হত্যা যদি পাপ হয় তো সকল হত্যাই সমান । কিন্তু কে বলে হত্যা পাপ ? হত্যা তো প্রতিদিনই হইতেছে। কেহ বা মাথায় একখণ্ড পাথর পড়িয়া হত হইতেছে, কেহ বা বন্যায়। ভাসিয়া গিয়া হত হইতেছে, কেহ বা মড়কের মুখে পড়িয়া হত হইতেছে, কেহ বা মনুষ্যের ছুরিকাঘাতে হত হইতেছে। কত পিপীলিকা আমরা প্রত্যহ পদতলে দলন করিয়া যাইতেছি, আমরা তাহাদের অপেক্ষা এমনই কি বড়ো ? এই-সকল ক্ষুদ্র প্রাণীদের জীবন-মৃত্যু খেলা বৈ তো নয়, মহাশক্তির মায়া বৈ তো নয় । কালরূপিণী মহামায়ার নিকটে প্রতিদিন এমন কত লক্ষকোটি প্রাণীর বলিদান হইতেছে— জগতের চতুর্দিক হইতে জীবশোণিতের স্রোত তাহার মহাখপরে আসিয়া গড়াইয়া পড়িতেছে । আমিই নাহয় সেই স্রোতে আর-একটি কণা যোগ করিয়া দিলাম। র্তাহার বলি তিনিই এক কালে গ্রহণ করিতেন, আমি নাহয় মাঝখানে থাকিয়া উপলক্ষ হইলাম । তখন জয়সিংহ প্ৰতিমার দিকে ফিরিয়া কহিতে লাগিলেন, “এইজন্যই কি তোকে সকলে মা বলে মা ! তুই এমন পাষাণী ! রাক্ষসী, সমস্ত জগৎ হইতে রক্ত নিষ্পেষণ করিয়া লইয়া উদরে পুরিবার জন্য তুই ঐ লোল জিহবা বাহির করিয়াছিস । স্নেহ প্রেম মমতা সৌন্দর্য ধর্ম সমস্তই মিথ্যা, সত্য কেবল তোর ঐ অনন্ত রক্তত্ষা ! তোরই উদর-পূরণের জন্য মানুষ মানুষের গলায় ছুরি বসাইবে, ভাই ভাইকে খুন করিবে, পিতাপুত্রে কাটাকাটি করিবে ! নিষ্ঠুর, সত্যসত্যই এই যদি তোর ইচ্ছ। তবে মেঘ রক্তবর্ষণ করে না কেন, করুণাস্বরূপিণী নদী রক্তস্রোত লইয়া রক্তসমুদ্রে গিয়া পড়ে না কেন ? না, না, মা, তুই প্রকাশ করিয়া বল— এ শিক্ষা মিথ্যা, এ শাস্ত্র মিথ্যা— আমার মাকে মা বলে না, সন্তানরক্তপিপাসু রাক্ষসী বলে, এ কথা আমি সহিতে পারিব না ।” জয়সিংহের চক্ষু দিয়া অশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল— তিনি নিজের কথা লইয়া নিজেই ভাবিতে লাগিলেন। এত কথা ইতিপূর্বে কখনাে তাহার মনে হয় নাই, রঘুপতি যদি তাহাকে নূতন শাস্ত্র শিক্ষা দিতে না আসিতেন, তবে কখনোই তাহার এত কথা মনেই আসিত না । রঘুপতি ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “তবে তো বলিদানের পালা একেবারে উঠাইয়া দিতে হয় ।” জয়সিংহ অতি শৈশবকাল হইতে প্রতিদিন বলিদান দেখিয়া আসিতেছেন । এইজন্য, মন্দিরে যে বলিদান কোনোকালে বন্ধ হইতে পারে কিম্বা হওয়া উচিত এ কথা কিছুতেই তাহার মনে লাগে না । এমন-কি, এ কথা মনে করিতে র্তাহার হৃদয়ে আঘাত লাগে। এইজন্য রঘুপতির কথার উত্তরে জয়সিংহ বলিলেন, “সে স্বতন্ত্র কথা । তাহার অন্য কোনাে অর্থ আছে। তাহাতে তো কোনো পাপ নাই । কিন্তু তাই বলিয়া ভাইকে ভাই হত্যা করিবে !! তাই বলিয়া মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যাকে- প্ৰভু, আপনার পায়ে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করি, আমাকে প্রবঞ্চনা করিবেন না, সত্যই কি মা স্বপ্নে কহিয়াছেন রাজরক্ত নাহিলে তার তৃপ্তি হইবে না ?”