পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি SV আপনাকে ত্যাগ করিতে পারি না। আমি রহিলাম— আপনার পদতলেই রহিলাম, আপনি যাহা ইচ্ছা! করিবেন । আপনার পথ ছাড়া আমার অন্য পথ নাই ।” রঘুপতি তখন জয়সিংহকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিলেন— তাহার অশ্রু প্রবাহিত হইয়া জয়সিংহের স্কন্ধে পড়িতে লাগিল । তাহারা নানা কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “আমরা ঠাকরুন-দর্শন করিতে আসিয়াছি।” রঘুপতি বলিয়া উঠিলেন, “ঠাকরুন কোথায় ! ঠাকরুন। এ রাজ্য থেকে চলে গেছেন । তোরা রাখতে পারলি কই ! তিনি চলে গেছেন ।” গোলমাল উঠিল, নানা দিক হইতে নানা কথা শুনা যাইতে লাগিল । ক “আমরা কী অপরাধ করেছি। ঠাকুর ?” “মা কি কিছুতেই প্ৰসন্ন হবেন না ?” “আমার ভাইপোর ব্যামো ছিল ব'লে আমি ক'দিন পুজো দিতে আসি নি।” (তার দৃঢ় বিশ্বাস, তাহারই উপেক্ষা সহিতে না পারিয়া দেবী দেশ ছাড়িতেছেন ।) “আমার পাঠা-দুটি ঠাকরুনকে দেব মনে করেছিলুম, বিস্তর দূর বলে আসতে পারি নি।” (দুটাে পাঠা দিতে দেরি করিয়া রাজ্যের যে এরূপ অমঙ্গল ঘটিল, ইহাই মনে করিয়া সে কাতর হইতেছিল ।) “ গোবর্ধন যা মানত করেছিল তা মাকে দেয় নি বটে, কিন্তু মাও তো তেমনি তাকে শাস্তি দিয়েছেন । তার পিলে বেড়ে ঢাকা হয়েছে, সে আজ ছ। মাস বিছানায় পড়ে।” (গোবর্ধন তাহার প্লীহার আতিশয্য লইয়াই চুলায় যাক, মা দেশে থাকুন— এইরূপ সে মনে মনে প্রার্থনা করিল। সকলেই অভাগা গোবর্ধনের প্লীহার প্রচুর উন্নতি কামনা করিতে লাগিল ।) ভিড়ের মধ্যে একটি দীর্ঘপ্রস্থ লোক ছিল, সে সকলকে ধমক দিয়া থামাইল এবং রঘুপতিকে জোড়হস্তে কহিল, “ঠাকুর, মা কেন চলিয়া গেলেন, আমাদের কী অপরাধ হইয়াছিল ?” যুগুত কহিলেন, “তাের মায়ের জন্য এক ফোটা রক্ত দিতে পারিস যে, এই তাে তােলের ভক্তি !” সকলে চুপ করিয়া রহিল। অবশেযে কথা উঠিতে লাগিল। অস্পষ্ট স্বরে কেহ কেহ বলিতে লাগিল, “রাজার নিষেধ, আমরা কী করিব !” জয়সিংহ প্রস্তরের পুত্তলিকার মতো স্থির হইয়া বসিয়া ছিলেন। ‘মায়ের নিষেধ এই কথা তড়িদবেগে তাহার রসনাগ্রে উঠিয়াছিল ; কিন্তু তিনি আপনাকে দমন করিলেন, একটি কথা কহিলেন না ! রঘুপতি তীব্ৰস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “রাজা কে ! মায়ের সিংহাসন কি রাজার সিংহাসনের নীচে ? তবে এই মাতৃহীন দেশে তােদের রাজাকে লইয়াই তােরা থাক। দেখি তােদের কে রক্ষা করে।” জনতার মধ্যে গুন গুন শব্দ উঠিল। সকলেই সাবধানে কথা কহিতে লাগিল । রঘুপতি দাড়াইয়া উঠিয়া বলিলেন, “রাজাকেই বড়ো করিয়া লইয়া তোদের মাকে তোরা রাজ্য হইতে অপমান করিয়া বিদায় করিলি । সুখে থাকিবি মনে করিস নে। আর তিন বৎসর পরে এতবড়ো রাজ্যে তোদের ভিটের চিহ্ন থাকিবে না— তোদের বংশে বাতি দিবার কেহ থাকিবে না।” জনতার মধ্যে সাগরের গুন গুন শব্দ ক্রমশ স্ফীত হইয়া উঠিতে লাগিল। জনতাও ক্রমে বাড়িতেছে । সেই দীর্ঘ লোকটি জোড়হাত করিয়া রঘুপতিকে কহিল, “সন্তান যদি অপরাধ করে থাকে