পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি ዒwoዒ দুর্গপ্রবেশের জন্য আর-কোনো পরিচয় আবশ্যক ছিল না । রা ভাবিয়া N কিন্তু আজ যুদ্ধের দিনে কী করা উচিত রঘুপতি কহিলেন, “তোমরা আশ্রয় না দিলে মুসলমানদের হাতে আমাকে মরিতে হইবে।” বিক্রমসিংহের কানে যখন এ কথা গেল তখন তিনি ব্ৰাহ্মণকে দুর্গের মধ্যে আশ্রয় দিতে অনুমতি করিলেন। প্রাচীরের উপর হইতে একটা মই নামানাে হইল, রঘুপতি দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। দুর্গের মধ্যে যুদ্ধের প্রতীক্ষায় সকলেই ব্যস্ত। বৃদ্ধ খুড়াসাহেব ব্ৰাহ্মণ-অভ্যর্থনার ভার স্বয়ং লাইলেন। তাহার প্রকৃত নাম খড়গসিংহ, কিন্তু তাহাকে কেহ বলে খুড়াসাহেব, কেহ বলে সুবাদার-সাহেব- কেন যে বলে তাহার কোনাে কারণ পাওয়া যায় না। পৃথিবীতে তাহার ভ্রাতুষ্পপুত্র নাই, ভাই নাই, তাহার খুড়া হইবার কোনাে অধিকার বা সুদূর সম্ভাবনা নাই এবং তাহার ভ্রাতুষ্পপুত্র যতগুলি তাহার সুবা তাহার অপেক্ষা অধিক নহে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেহ তাহার উপাধি সম্বন্ধে কোনােপ্রকার আপত্তি অথবা সন্দেহ উত্থাপিত করে নাই। যাহারা বিনা ভাইপােয় খুড়া, বিনা সুবায় সুবাদার, সংসারের অনিত্যতা ও লক্ষ্মীর চপলতা -নিবন্ধন তাঁহাদের পদচ্যুতির কোনাে আশঙ্কা নাই । খুড়াসাহেব আসিয়া কহিলেন, “বাহবা, এই তো ব্ৰাহ্মণ বটে !” বলিয়া ভক্তিভারে প্রণাম করিলেন । মুক্তির একপ্রকার তেলীয়ান দীপশিখার মতাে আকৃতি ছিল যাহা দেখিয়া সহসা পতঙ্গের যুদ্ধ হইয়া খুড়াসাহেব জগতের বর্তমান শোচনীয় অবস্থায় বিষন্ন হইয়া কহিলেন, “ঠাকুর, তেমন ব্ৰাহ্মণ আজকাল কটা মেলে ।” 準 রঘুপতি কহিলেন, “অতি অল্প ।” খুড়াসাহেব কহিলেন, “আগে ব্ৰাহ্মণের মুখে অগ্নি ছিল, এখন সমস্ত অগ্নি জঠরে আশ্রয় লইয়াছে।” রঘুপতি কহিলেন, “তাও কি আগেকার মতো আছে ?” খুড়াসাহেব মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “ঠিক কথা । অগস্ত্য মুনি যে-আন্দাজ পান করিয়াছিলেন সে-আন্দাজ যদি আহার করিতেন তাহা হইলে একবার বুঝিয়া দেখুন।” রঘুপতি কহিলেন, “আরো দৃষ্টান্ত আছে।” খুড়াসাহেব । হা আছে বৈকি। জহ্ন মুনির পিপাসার কথা শুনা যায়, তাহার ক্ষুধার কথা কোথাও লেখে নাই, কিন্তু একটা অনুমান করা যাইতে পারে। হর্তৃক খাইলেই যে কম খাওয়া হয় তাহা নহে, ক'টা করিয়া হতুকি তাহারা রোজ খাইতেন তাহার একটা হিসাব থাকিলে তবু বুঝিতে পারিতাম । রঘুপতি ব্ৰাহ্মণের মাহাত্ম্য স্মরণ করিয়া গভীর ভাবে কহিলেন, “না সাহেব, আহারের প্রতি র্তাহাদের যথেষ্ট মনোযোগ ছিল না ।” খুড়াসাহেব জিভ কাটিয়া কহিলেন, “রাম রাম, বলেন কী ঠাকুর ? তাহাদের জঠরানল যে অত্যন্ত প্রবল ছিল তাহার বিশিষ্ট প্রমাণ আছে। দেখুন-না কেন, কালক্রমে আর-সকল অগ্নিই নিবিয়া গেল, হােমের অগ্নিও আর জ্বলে না, কিন্তু-” রঘুপতি কিঞ্চিৎ ক্ষুন্ন হইয়া কহিলেন, “হােমের অগ্নি আর জ্বলিবে কী করিয়া ? দেশে ঘি রহিল কই ? পাষণ্ডেরা সমস্ত গোরু পার করিয়া দিতেছে, এখন হাব্য পাওয়া যায় কোথায় ? হােমাগ্নি না জ্বলিলে ব্ৰহ্মতেজ আর কতদিন টেকে ?” বলিয়া রঘুপতি নিজের প্রচ্ছন্ন দাহিকাশক্তি অত্যন্ত অনুভব করিতে লাগিলেন । খুড়াসাহেব কহিলেন, “ঠিক বলিয়াছেন ঠাকুর, গোরুগুলো মরিয়া আজকাল মনুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করিতে আরম্ভ করিয়াছে, কিন্তু তাহাদের কাছ হইতে ঘি পাইবার প্রত্যাশা করা যায় না । মগজের সম্পূর্ণ অভাব । ঠাকুরের কোথা হইতে আসা হইতেছে ?” রঘুপতি কহিলেন, “ত্রিপুরার রাজবাটী হইতে ।” বিজয়গড়ের বহিঃস্থিত ভারতবর্ষের ভূগােল অথবা ইতিহাস সম্বন্ধে খুড়াসাহেবের যৎসামান্য জানা ছিল । বিজয়গড় ছাড়া ভারতবর্ষে জানিবার যোগ্য যে আর-কিছু আছে তাহাও তাহার বিশ্বাস নহে। » ዘ8ዒ