পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি ዓ (፩ዒ বিতে পারিস ?” বলিয়া মুকুট ভূমিতে ফেলিয়া দিলেন, একটি বড়ো মুক্ত ছিড়িয়া পড়িয়া গেল । খুব আগ্রহের সহিত হাত বাড়াইয়া কহিল, “আমি নেব।” রাজা ধ্রুবের মাথায় মুকুট পরাইয়া তাহাকে কোলে লইয়া কহিলেন, “এই লও— আমি কাহারও ত ঝগড়া করিতে চাই না।” বলিয়া অত্যন্ত আবেগের সহিত ধ্রুবকে বুকে চাপিয়া ধরিলেন । তাহার পরে সমস্ত দিন ধরিয়া “এ কেবল আমারই পাপের শাস্তি বলিয়া রাজা নিজের সহিত তৰ্ক লাগিলেন । নহিলে ভাই কখনো ভাইকে আক্রমণ করে না । ইহা মনে করিয়া তাহার কথঞ্চিৎ হইল । তিনি মনে করিলেন, ইহা ঈশ্বরের বিধান । জগৎপতির দরবার হইতে আদেশ সিয়াছে, ক্ষুদ্র নক্ষত্ররায় কেবল তাহার মানবহৃদয়ের প্ররোচনায় তাহা লঙঘন করিতে পারে না । এই করিয়া তাহার আহত মেহ কিছু শান্তি পাইল । পাপ তিনি নিজের স্কন্ধে লইতে রাজি আছেন— ক্ষত্ররায়ের পাপের ভার যেন তাহাতে কতকটা কমিয়া যায় । রাজা কহিলেন, “ঠাকুর, এ-সকল আমারই পাপের ফল ।” বিন্ধন কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “মহারাজ, এই-সকল কথা শুনিলে আমার ধৈর্য থাকে না । দুঃখ যে পাপেরই ফল তাহা কে বলিল, পুণ্যের ফলও হইতে পারে। কত ধর্মাত্মা আজীবন দুঃখে৷ কাটাইয়া গিয়াছেন।” বিম্বন জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ কী পাপ করিয়াছিলেন যাহার ফলে এই ঘটনা ঘটিল ?” রাজা কহিলেন, “আপন ভাইকে নির্বাসিত করিয়াছিলাম।” বিম্বন কহিলেন, “আপনি ভাইকে নির্বাসিত করেন নাই । দোষীকে নির্বাসিত করিয়াছেন ।” রাজা কহিলেন, “দোষী হইলেও ভাইকে নির্বাসনের পাপ আছেই। তাহার ফল হইতে নিস্তার পাওয়া যায় না । কৌরবেরা দুরাচার হইলেও পাণ্ডবেরা র্তাহাদিগকে বধ করিয়া প্ৰসন্নচিত্তে রাজ্যসুখ ভোগ করিতে পারিলেন না । যজ্ঞ করিয়া প্ৰায়শ্চিত্ত করিলেন । পাণ্ডবেরা কৌরবদের নিকট হইতে রাজ্য লইলেন, কৌরবেরা মরিয়া গিয়া পাণ্ডবদের রাজ্য হরণ করিলেন । আমি নক্ষত্ৰকে নির্বাসিত করিয়াছি, নক্ষত্র আমাকে নির্বাসিত করিতে আসিতেছে।” বিন্ধন কহিলেন, “পাণ্ডবেরা পাপের শাস্তি দিবার জন্য কৌরবদের সহিত যুদ্ধ করেন নাই, তাহারা রাজ্যলাভের জন্য করিয়াছিলেন । কিন্তু মহারাজ পাপের শাস্তি দিয়া নিজের সুখদুঃখ উপেক্ষা করিয়া ধর্ম পালন করিয়াছিলেন । ইহাতে আমি তো পাপ কিছুই দেখিতেছি না। তবে প্ৰায়শ্চিত্তের বিধি দিতে কিছুমাত্র আপত্তি নাই। আমি ব্রাহ্মণ উপস্থিত আছি, আমাকে সন্তুষ্ট করলেই প্ৰায়শ্চিন্তু হবে ।” রাজা ঈষৎ হাসিয়া চুপ করিয়া রহিলেন । বিন্ধন কহিলেন, “সে যাহাই হউক, এখন যুদ্ধের আয়োজন করুন। আর বিলম্ব করিবেন না।” রাজা কহিলেন, “আমি যুদ্ধ করিব না।” বিন্ধন কহিলেন, “সে হইতেই পারে না। আপনি বসিয়া বসিয়া ভাবুন। আমি ততক্ষণ সৈন্যসংগ্রহের চেষ্টা করিগে । সকলেই এখন জুমে গিয়াছে, যথেষ্ট সৈন্য পাওয়া কঠিন ।” বলিয়া আর কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া বিন্ধন চলিয়া গেলেন । ধ্ৰুবের সহসা কী মনে হইল ; সে রাজার কাছে আসিয়া রাজার মুখের দিকে তাকাইয়া জিজ্ঞাসা গরিল, “কাক কোথায় ?” রাজা কহিলেন “কাকা আসিতেছেন ধ্রুব।” তীহার চোখের পাতা ঈষৎ আদ্ৰ হইয়া গেল ।