পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১০

ዒ ዒbr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী কিন্তু যে কার্যের জন্য গিয়াছেন সেই কার্য সাধন করিয়া আসিলে তবে তিনি আমাদের অনুগ্রহের অধিকারী হইবেন ।” সুজা এই পত্র পাঠ করিয়া বজাহত হইলেন। মহম্মদ বার বার করিয়া বলিলেন, তিনি কখনোই পিতার নিকটে অনুতাপ প্রকাশ করেন নাই। এ-সমস্তই তাহার পিতার কৌশল। কিন্তু সুজার সন্দেহ দূর হইল না। সুজা তিন দিন ধরিয়া চিন্তা করিলেন। অবশেষে চতুর্থ দিনে কহিলেন, “বৎস, আমাদের মধ্যে বিশ্বাসের বন্ধন শিথিল হইয়াছে। অতএব আমি অনুরোধ করিতেছি, তুমি তোমার স্ত্রীকে লইয় প্ৰস্থান করো, নহিলে আমাদের মনে আর শান্তি থাকিবে না। আমার রাজকোষের দ্বার মুক্ত কবিয়া দিলাম, শ্বশুরের উপহারস্বরূপ যত ইচ্ছা ধনরত্ন লইয়া যাও ।” মহম্মদ অশ্রুবিসর্জন করিয়া বিদায় লইলেন, তাহার স্ত্রী তাহার সঙ্গে গেলেন । সুজা কহিলেন, “আর যুদ্ধ করিব না। চট্টগ্রামের বন্দর হইতে জাহাজ লইয়া মক্কায় চলিয়া যাইব ।” বলিয়া ঢাকা ছাড়িয়া ছদ্মবেশে চলিয়া গেলেন । চতুশ্চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ যে দুর্গে গোবিন্দমাণিক্য বাস করিতেন, একদিন বর্ষার অপরাহুে সেই দুর্গের পথে একজন ফকির সঙ্গে তিনজন বালক ও একজন প্ৰাপ্তবয়স্ক তল্পিদার লইয়া চলিয়াছেন । বালকদের অত্যন্ত ক্লান্ত দেখাইতেছে । বাতাস বেগে বহিতেছে এবং অবিশ্রাম বর্ষার ধারা পড়িতেছে। সকলের চেয়ে ছোটাে বালকটির বয়স চৌদর অধিক হইবে না, সে শীতে কঁাপিতে কঁাপিতে কাতর স্বরে কহিল, “পিতা, আর তো পারি না ।” বলিয়া অধীর ভাবে কঁদিতে লাগিল । ফকির কিছু না বলিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া তাহাকে বুকের কাছে টানিয়া লইলেন । বড়ো বালকটি ছোটোকে তিরস্কার করিয়া কহিল, “পথের মধ্যে এমন করিয়া কাদিয়া ফল কী ? চুপ৷ কর । অনর্থক পিতাকে কাতর করিস নে ৷” ছোটো বালকটি তখন তাহার উচ্ছসিত ক্ৰন্দন দমন করিয়া শান্ত হইল । মধ্যম বালকটি ফকিরকে জিজ্ঞাসা করিল, “পিতা, আমরা কোথায় যাইতেছি ?” ফকির কহিলেন, “ঐ যে দুর্গের চূড়া দেখা যাইতেছে, ঐ দুর্গে যাইতেছি।” “ওখানে কে আছে পিতা ?” “শুনিয়াছি কোথাকার একজন রাজা সন্ন্যাসী হইয়া ওখানে বাস করেন ।” “রাজা সন্ন্যাসী কেন হইল পিতা !” ফকির কহিলেন, “জানি না বাছা ! হয়তো তাহার। আপনার সহােদর ভ্ৰাতা সৈন্য লইয়া তীহাকে একটা গ্ৰাম্য কুকুরের মতো দেশ হইতে দেশান্তরে তাড়া করিয়াছে। রাজ্য ও সুখসম্পদ হইতে তীহাকে পথে বাহির করিয়া দিয়াছে। এখন হয়তো কেবল দারিদ্র্যের অন্ধকার ক্ষুদ্র গহবর ও সন্ন্যাসীর গেরুয় বসন পৃথিবীর মধ্যে র্তাহার একমাত্র লুকাইবার স্থান । আপনার ভ্রাতার বিদ্বেষ হইতে, বিষদন্ত হইতে, আর কোথাও রক্ষা নাই ।” বলিয়া ফকির দৃঢ়রপে আপন ওষ্ঠাধর চাপিয়া হৃদয়ের আবেগ দমন করিলেন। বড়ো ছেলেটি জিজ্ঞাসা করিল, “পিতা, এই সন্ন্যাসী কোন দেশের রাজা ছিল ?” ফকির কহিলেন, “তাহা জানি না বাছা !” “যদি আমাদের আশ্রয় না দেয় ?” “তবে আমরা বৃক্ষতলে শয়ন করিব। আর আমাদের স্থান কোথায় !" সন্ধ্যার কিছু পূর্বে দুর্গে সন্ন্যাসী ও ফকিরে দেখা হইল। উভয়েই উভয়কে দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলেন । গোবিন্দমাণিক্য চাহিয়া দেখিলেন, ফকিরকে ফকির বলিয়া বোধ হইল না । ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থপর বাসনা হইতে হৃদয়কে প্রত্যাহরণ করিয়া একমাত্র বৃহৎ উদ্দেশ্যের মধ্যে স্থাপন করিলে মুখে যে