পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

b>o রবীন্দ্র-রচনাবলী পঞ্চম পত্ৰ বিলেতে নতুন এসেই বাঙালিদের চােখে কোন জিনিস ঠেকে, বিলিতি সমাজে নতুন মিশে প্রথমে বাঙালিদের কী রকম লাগে, সে-সকল বিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আপাতত কিছু বলব না । কেননা, এ-সকল বিষয় আমার বিচার করবার অধিকার নেই, যারা পূর্বে অনেক কাল বিলেতে আমি বাস করছি । বিলোতে আসবার আগেই বিলেতের বিষয় তাদের কাছে অনেক শুনতে পেতেম, সুতরাং এখানে এসে খুব অল্প জিনিস নিতান্ত নতুন মনে হয়েছে। এখানকার লোকের সঙ্গে মিশতে গিয়ে প্রতি পদে কুঁচটি খেয়ে খেয়ে আচার-ব্যবহার আমাকে শিখতে হয় নি। তাই ভাবছি যে, আমার নিজের অভিজ্ঞতার বিষয় আপাতত তোমাদের কিছু বলব না । এখানকার দুই-একজন বাঙালির মুখে তাদের যেরকম বিবরণ শুনেছি। তাই তোমাদের লিখছি । জাহাজে তো তারা উঠলেন । যাত্রীদের সেবার জন্যে জাহাজে অনেক ইংরেজ চাকর থাকে তাদের নিয়েই প্ৰথম গোল বাধে । এরা অনেকে তাদের “সার” “সার” বলে সম্বোধন করতেন, তাদের কোনো কাজ করতে হুকুম দিতে তাদের বাধো-বাধো করত । জাহাজে তারা অত্যন্ত সসংকোচ ভাবে থাকতেন । তারা বলেন, সকল বিষয়েই তাদের যে ওরকম সংকোচ বোধ হত, সেটা কেবল ভয়ে নয়, তার সঙ্গে কতকটা লজাও আছে | যে-কাজ করতে যান, মনে হয় পাছে বেদস্তুর হয়ে পড়ে । জাহাজে ইংরেজদের সঙ্গে মেশা বড়ো হয়ে ওঠে না । তারা টাটকা ভারতবর্ষ থেকে আসছে, “হুজুর ধর্মাবতারগণ দেশী লোক দেখলে নাক তুলে, ঘাড় বেঁকিয়ে চলে যায় । মাঝে মাঝে ভদ্র ইংরেজ দেখতে পাবে, তারা তোমাকে নিতান্ত সঙ্গিহীন দেখে তোমার সঙ্গে মিশতে চেষ্টা করবেন, তারা যথার্থ ভদ্র, অর্থাৎ ভদ্র ও উচ্চ -পরিবারের লোক । এখানকার গলিতে গলিতে যে “জন-জোনস-টমাস”গণ কিলবিল করছে, তারা ভারতবর্ষের যে-অঞ্চলে পদার্পণ করে, সে-অঞ্চলে ঘরে ঘরে তাদের নাম রাষ্ট্র হয়ে যায়, যে-রাস্তায় তারা চাবুক হস্তে ঘোড়ায় চড়ে যায় (হয়তো সে চাবুক কেবলমাত্র ঘোড়ার জন্যেই নয়) সে রাস্তাসুদ্ধ লোক শশব্যস্ত হয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়, তাদের এক-একটা ইঙ্গিতে ভারতবর্ষের এক-একটা রাজার সিংহাসন কেঁপে ওঠে, এরকম অবস্থায় তাদের যে বিকৃতি ঘটে আমি তো তাতে বিশেষ অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাই নে। কোনো জন্মে যে-মানুষ ঘোড়া চালায় নি, তাকে ঘোড়া চালাতে দাও, ঘোড়াকে চাবুক মেরে মেরেই জর্জরিত করবে ; সে জানে না যে, একটু লাগাম টেনে দিলেই তাকে চালানো যায় । কিন্তু মাঝে মাঝে এক-একটি ভদ্র সাহেবকে দেখা যায়, তারা অ্যাংগ্নো-ইন্ডিয়ানত্বের ঘোরতর সংক্রামক রোগের মধ্যে থেকেও বিশুদ্ধ থাকেন, অপ্ৰতিহত প্ৰভুত্ব ও ক্ষমতা পেয়েও উদ্ধত গর্বিত হয়ে ওঠেন না । সমাজশঙ্খল ছিন্ন হয়ে, সহস্র সেবকদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে ভারতবর্ষে থাকা উন্নত ভদ্র মনের একপ্রকার অগ্নিপরীক্ষা । যা হোক, এতক্ষণে জাহাজ সাউদ্যাম্পটনে এসে পৌচেছে । বঙ্গীয় যাত্রীরা বিলেতে এসে পৌছলেন। লন্ডন উদ্দেশে চললেন । ট্রেন থেকে নাববার সময় একজন ইংরেজ গার্ড এসে উপস্থিত । বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে তাদের কী প্রয়োজন আছে, কী করে দিতে হবে । তাদের মোট নাবিয়ে দিলে, গাড়ি ডেকে দিলে, তারা মনে মনে বললেন, “বাঃ ! ইংরেজরা কী ভদ্র !’ ইংরেজরা যে এত ভদ্র হতে পারে, তা তাদের জ্ঞান ছিল না । তার হস্তে একটি শিলিং গুজে দিতে হল বটে । তা হােক, একজন নবাগত বঙ্গ-যুবক একজন যে-কোনো শ্বেতাঙ্গের কাছ থেকে একটিমাত্র সেলাম পেতে, অকাতরে এক শিলিং ব্যয় করতে পারেন । আমি যাদের কাছ থেকে সব কথা শুনতে পাই, তারা অনেক বৎসর বিলোতে আছেন, বিলেতের নানাপ্রকার ছোটোখাটাে জিনিস দেখে তাদের প্রথম কী রকম মনে হয়েছিল, তা তাদের স্পষ্ট মনে নেই | যে-সব বিষয়ে তাদের বিশেষ মনে লেগেছিল, তাই এখনো তাদের মনে আছে । র্তারা বিলোতে আসবার পূর্বে তাদের বিলিতি বন্ধুরা এখানে তাদের জন্যে ঘর ঠিক করে