পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্ৰ br SᏔᏬ সেদিন একজন গল্প করছিলেন যে তাকে আর-একজন বাঙালি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, “মশায়ের কী কাজ করা হয় ?” এই গল্প শুনবামাত্র আমাদের একজন ইঙ্গবঙ্গ বন্ধু নিদারুণ ঘূণার সঙ্গে বলে উঠলেন, “দেখুন দেখি, কী বার্বারস !” ভাবটা এই যে, যেমন মিথ্যে কথা না বলা, চুরি না করা, নীতি-শাস্ত্রের কতকগুলি মূল নিয়ম, তেমনি অন্য মানুষকে তার জীবিকার কথা জিজ্ঞাসা না করাও একটা মূল নিয়মের মধ্যে । সেদিন এক জায়গায় আমাদের দেশের শ্রাদ্ধের কথা হচ্ছিল, বাপ-মার মৃত্যুর পর আমরা হবিষ্য করি, বেশভূষা করি নে ইত্যাদি । শুনে একজন ইঙ্গবঙ্গ যুবক অধীর ভাবে আমাকে বলে উঠলেন যে, “আপনি অবিশ্যি, মশায়, এ-সকল অনুষ্ঠান ভালো বলেন না।” আমি বললেম, “কেন নয় ? আমি দেখছি ইংরেজেরা যদি আত্মীয়ের মৃত্যু উপলক্ষে হবিষ্যান্ন খেত, আর আমাদের দেশের লোকেরা না খেত, তা হলে হবিষ্যান্ন খায় না বলে আমাদের দেশের লোকের উপর তোমার দ্বিগুণতর ঘূণা হত ও মনে করতে হবিষ্যান্ন খায় না বলেই আমাদের দেশের এত দুৰ্দশা ।” তুমি হয়তো জানো, ইংরেজেরা এক টেবিলে তেরো জন খাওয়া অলক্ষণ মনে করে, তাদের বিশ্বাস তা হলে এক বৎসরের মধ্যে তাদের একজনের মৃত্যু হবেই। একজন ইঙ্গবঙ্গ যখন নিমন্ত্রণ করেন তখন কোনোমতে তেরো জন নিমন্ত্রণ করেন না, জিজ্ঞাসা করলে বলেন, “আমি নিজে বিশ্বাস করি নে, কিন্তু র্যাদের নিমন্ত্রণ করি তারা পাছে ভয় পান। তাই বাধ্য হয়ে এ নিয়ম পালন করতে হয় ।” সেদিন একজন ইঙ্গবঙ্গ তার একটি আত্মীয় বালককে রবিবার দিনে রাস্তায় খেলা করতে যেতে বারণ করছিলেন । আমি জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, “রাস্তার লোকেরা কী মনে করবে ?” কতকগুলি বাঙালি বলেন, এখানকার মতো ঘর ভাড়া দেবার প্রথা তারা আমাদের দেশে প্রচলিত করবেন । তাদের সেই একটিমাত্র সাধ । আর-একজন বাঙালি বাংলা সমাজ সংস্কার করতে চান, বিলেতের সমাজে মেয়ে পুরুষে একত্রে নােচাটাই তার চোখে অত্যন্ত ভালো লেগেছে। কতকগুলি সাধারণ বিষয়ে আমাদের দেশের ও এ-দেশের মেয়েদের অমিল দেখে তার পরে তিনি কতকগুলি বিশেষ বিশেষ বিষয় নিয়ে ছেলেমানুষের মতো খুঁতখুঁত করতে থাকেন। একজন ইঙ্গবঙ্গ নালিশ করছিলেন যে, আমাদের দেশের মেয়েরা পিয়ানো বাজাতে পারে না, ও এখানকার মতো ভিজিটারদের সঙ্গে দেখা করতে ও ভিজিট প্ৰত্যপণ করতে যায় না । এইরকম ক্রমাগত প্ৰতি ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে এ দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা করে করে তাদের চটাভােব চটনমান যন্ত্রে ব্লাড হীট ছাড়িয়ে ওঠে। একজন ইঙ্গবঙ্গ তার সমবেদক বন্ধুদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে বলছিলেন যে, যখন তিনি মনে করেন যে, দেশে ফিরে গেলে তাকে চারি দিকে ঘিরে মেয়েগুলো প্যান প্যান করে কঁদতে আরম্ভ করবে, তখন আর তার দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না । অর্থাৎ তিনি চান যে, তাকে দেখবামাত্রই “ডিয়ার ডার্লিং বলে ছুটে এসে তার স্ত্রী তাকে আলিঙ্গন ও চুম্বন করে তার কাধে মাথা দিয়ে দাড়িয়ে তাদের গবেষণা দেখলে তাদের উপর ভক্তির উদয় হয় । কোটের কোন ছাটটা ফ্যাশন-সংগীত, আজকাল নােবিলিটি আঁটি প্যান্টলুন পরেন কি ঢলকো পরেন, ওয়ালটুস নাচেন কি পোলকা মজুর্কা, মাছের পর মাংস খােন কি মাংসের পর মাছ, সে-বিষয়ে তারা অভ্ৰান্ত খবর রাখেন । ঐরকম না। তুমি যদি মাছ খাবার সময় ছুরি ব্যবহার কর তবে একজন ইংরেজ তাতে বড়ো আশ্চর্য হবেন না, কেননা তিনি জানেন তুমি বিদেশী, কিন্তু একজন ইঙ্গবঙ্গ সেখানে উপস্থিত থাকলে তার স্মেলিং সলটের আবশ্যক করবে। তুমি যদি শেরি খাবার গ্লাসে শ্যাম্পেন খাও তবে একজন ইঙ্গবঙ্গ তোমার দিকে হী করে চেয়ে থাকবেন, যেন তোমার এই অজ্ঞতার জন্যে সমস্ত পৃথিবীর সুখ শান্তি নষ্ট হবার উপক্রম হয়েছে। সন্ধেবেলায় তুমি যদি মনিং কোট পর, তা হলে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট হলে, জেলে নির্জনবাসের আজ্ঞা দিতেন । একজন বিলেত-ফেরত কাউকে মটন দিয়ে রাই দিয়ে খেতে দেখলে বলতেন, “তবে কেন মাথা দিয়ে চল না ?”