পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brSbr রবীন্দ্র-রচনাবলী গান অভ্যাস করেন । বাড়ির মধ্যে তিনিই গাইয়ে বাজিয়ে । আজকাল স্কুল বন্ধ, ছোটাে ছেলেটি ও মেয়েটি ভারি খেলায় মগ্ন । দেড়টার সময় আমাদের লাঞ্চ খাওয়া সমাপন হলে আবার যিনি র্যার কাজে নিযুক্ত হন । এই সময়ে ভিজিটরদের আসবার সময় । হয়তো মিসেস ক- তার স্বামীর এক জোড়া ছেড়া মোজা নিয়ে চশমা পরে ড্রয়িংরুমে বসে সেলাই করছেন । ছোটো মেয়ে একটি পশমের জামা তার ভাইপোর জন্যে তৈরি করে দিচ্ছেন । মেজো মেয়েটি একটু অবসর পেয়ে আগুনের কাছে বসে হয়তো গ্ৰীনের লিখিত ইংরেজ জাতির ইতিহাস পড়তে নিযুক্ত । বড়ো মিস ক— হয়তো তার কোনো আলােপীর বাড়িতে ভিজিট করতে গিয়েছেন । তিনটের সময় হয়তো একজন ভিজিটর এলেন । দাসী ড্রয়িংরুমে এসে নাম উচ্চারণ করলে “মিস্টার ও মিসেস এ-” বলতে বলতে ঘরের মধ্যে তারা দুজনে উপস্থিত । মোজা জামা রেখে, বই মুড়ে, গৃহিণী ও তার কন্যারা আগন্তুকদের অভ্যর্থনা করলেন । আবহাওয়া সম্বন্ধে পরস্পরের মতামতের ঐক্য নিয়ে আলাপ শুরু হল । মিসেস এ— বললেন, “মিস্টার একস—এর তেতাল্লিশ বৎসর বয়সে হাম হয় । হাম হয়েছিল বলে তিনি চারদিন আপিসে যেতে পারেন নি । কাল আপিসে গিয়েছিলেন । তার হামের প্রসঙ্গে আপিসের লোকেরা তাকে নির্দয়ারূপে ঠাট্টা করতে আরম্ভ করেছে।” অন্যেরা লোকটি সম্বন্ধে দরদ প্ৰকাশ করলে । এই কথা থেকে ক্রমে হামরোগের বিষয়ে যত কথা উঠতে পারে উঠল । মিস ক— খবর দিলেন মিস্টার জ-এর তৃতীয় ছেলেটির হাম হয়েছে। তার থেকে কথা উঠল যে, মিস্টার জ-এর যে এক পিতৃব্য বোন মিস ই— অস্ট্রেলিয়ায় আছেন, তার কাপ্তেন ব-এর সঙ্গে বিবাহ হয়ে গেছে। এইরকম খানিকক্ষণ কথোপকথন হলে পর তারা চলে গেলেন । বিকেলে হয়তো আমরা সবাই মিলে একটু বেড়াতে গেলুম । বেড়িয়ে এসে সাড়ে ছ-টার সময় আমাদের ডিনার। ডিনার খেয়ে সাতটার সময় আমরা সবাই মিলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসি । আগুন জ্বলছে। ঘরটি বেশ গরম হয়ে উঠেছে। আমরা আগুনের চার দিকে ঘিরে বসলুম। এক-একদিন আমাদের গান-বাজনা হয় । আমি ইতিমধ্যে অনেক ইংরেজি গান শিখেছি । আমি গান করি । মিস ক- বাজান । মিস ক- আমাকে অনেকগুলি গান শিখিয়েছেন । কিন্তু প্ৰায় সন্ধেবেলায় আমাদের একটু আধটু পড়াশুনা হয় । আমরা পালা করে ছদিনে ছরকমের বই পড়ি ; বই পড়তে পড়তে এক-একদিন প্ৰায় সাড়ে—এগারোটা বারোটা হয়ে যায় । ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গেছে। তারা আমাকে আর্থার খুড়ো বলে। এথেল ছোটাে মেয়েটির ইচ্ছে যে আমি কেবল একলা তারই আঙ্কল আর্থার হই। তার ভাই টম যদি আমাকে দাবি করে তবেই তার দুঃখ । একদিন টম তার ছোটাে বোনকে রাগাবার জন্যে একটু বিশেষ জোর দিয়ে বলেছিল, আমারই আঙ্কল আর্থার । তখনই এথেল আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁট দুটি ফুলিয়ে কঁদতে আরম্ভ করে দিলে | টম একটু অস্থির, কিন্তু ভারি ভালোমানুষ । খুব মোটাসোটা । মাথাটা খুব প্ৰকাণ্ড । মুখটা খুব ভারী ভারী । সে এক-এক সময়ে আমাকে এক-একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল, “আচ্ছা, আঙ্কল আর্থর, ইদুররা কী করে ?” আঙ্কল বললেন, “তারা রান্নাঘর থেকে চুরি করে খায়।” সে একটু ভেবে বললে, “চুরি করে ? আচ্ছা, চুরি করে কেন ?” আঙ্কল বললেন, “তাদের খিদে পায় বলে ।” শুনে টমের বড়ো ভালো লাগল না । সে বরাবর শুনে আসছে যে, জিজ্ঞাসা না করে পরের জিনিস নেওয়া অন্যায়। আর একটি কথা না বলে সে চলে গেল। যদি তার বোন কখনো কাদে, সে তাড়াতাড়ি এসে সাত্ত্বনার স্বরে বলে, “Oh poor Ethel, don’t you cry ! Poor Ethel !” এথেলের মনে মনে জ্ঞান আছে যে, সে একজন লেডি । সে কেমন গভীর ভাবে কেদারায় ঠেস দিয়ে বসে। টমকে এক-এক সময়ে ভৎসনা করে বলে, “আমাকে বিরক্ত কোরো না ।” একদিন টম পড়ে গিয়ে কাদছিল । আমি তাকে বললেম, “ছি, কঁদতে আছে।” অমনি এথেল আমার কাছে ছুটে এসে জাক করে বললে, “আঙ্কল আর্থার, আমি একবার ছেলেবেলায় রান্নাঘরে পড়ে । গিয়েছিলেম, কিন্তু কঁাদি নি ।” ছেলেবেলায় ! মিস্টার ন-, ডাক্তারের আর-এক ছেলে, বাড়িতে থাকেন। কিন্তু তাকে দেখতে পাই নে । তিনি সমস্ত দিন আপিসে । আপিস থেকে এলেও তার বড়ো একটা দেখা পাওয়া যায় না । তার কারণ মিস