পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চিঠিপত্র brዔ S উপার্জন করিতে পারি, কিন্তু লাভ করিতে পারি না । আমরা জগতের সমস্ত জিনিসকে যতক্ষণ না আমার মধ্যে ফেলিয়া আমার করিয়া লইতে পারি, ততক্ষণ আমরা কিছুই পাই না । ঘাড়ের উপরে আসিয়া পড়িলেই তাহাকে পাওয়া বলে না । আমাদের চক্ষের স্নায়ু সূৰ্যকিরণকে আমাদের উপযোগী আলো-আকারে গড়িয়া লয়, তা না হইলে আমরা অন্ধ ; আমাদের অন্ধ চক্ষুর উপরে সহস্ৰ সূৰ্যকিরণ পড়িলেও কোনো ফল নাই। আমাদের হৃদয়ের সেই স্নায়ু কোথায় ! এ পক্ষাঘাতের আরোগ্য কিসে হইবে ! আমরা সাধনা কেন করি না ? সিদ্ধির জন্য আমাদের মাথাব্যথা নাই বলিয়া । সেই মাথাব্যাথাটা গোড়ায় চাই । ] অর্থাৎ, বাতিকের আবশ্যক । আমাদের শ্লেষ্মাপ্রধান ধাত, আমাদের বাতিকটা আদবেই নাই । আমরা ভারি ভদ্র, ভারি বুদ্ধিমান, কোনো বিষয়ে পাগলামি নাই । আমরা পাস করিব, রোজগার করিব, ও তামাক খাইব । আমরা এগোইব না, অনুসরণ করিব ; কাজ করিব না, পরামর্শ দিব ; দাঙ্গাহাঙ্গামাতে নাই, কিন্তু মকদ্দমা মামলা ও দলাদলিতে আছি । অর্থাৎ, হাঙ্গামের অপেক্ষা হুজতটা আমাদের কাছে যুক্তিসিদ্ধ বোধ হয়। লড়াইয়ের অপেক্ষা পলায়নেই পিতৃযশ রক্ষা হয় এইরূপ আমাদের বিশ্বাস । এইরূপ আত্যন্তিক স্নিগ্ধ ভাব ও মজাগত শ্লেষ্মার প্রভাবে নিদ্রাটা আমাদের কাছে পরম রমণীয় বলিয়া বোধ হয়, স্বপ্নটাকেই সত্যের আসনে বসাইয়া আমরা তৃপ্তি লাভ করি । অতএব স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, আমাদের প্রধান আবশ্যক বাতিক । সেদিন একজন বৃদ্ধ বাতিক গ্রস্তের সহিত আমার দেখা হইয়াছিল । তিনি বায়ুভরে একেবারে কত হইয়া পড়িয়াছেন— এমন-কি, অনেক সময়ে বায়ুর প্রকোপ তাহার আয়ুর প্রতি আক্রমণ করে । তাহার সহিত অনেকক্ষণ আলোচনা করিয়া স্থির করিলাম যে, আর কিছু না, আমাদের দেশে একটি বাতিক বর্ধনী সভার আবশ্যক হইয়াছে । সভার উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, কতকগুলা ভালোমানুষের ছেলেকে খেপাইতে হইবে । বাস্তবিক, প্রকৃত খেপা ছেলেকে দেখিলে চক্ষু জুড়াইয়া যায় । বায়ুর মাহাত্ম্য কে বর্ণনা করিতে পারে ? যে-সকল জাত উনবিংশ শতাব্দীর পরে উনপঞ্চাশ বায়ু লাগাইয়া চলিয়াছেন, আমরা সাবধানীরা কবে তাহাদের নাগাল পাইব ? আমাদের যে অল্প একটু বায়ু । আছে, সভার নিয়ম রচনা করিতে ও বক্তৃতা দিতেই তাহা নিঃশেষিত হইয়া যায়। মহৎ আশা, মহৎ ভাব, মহৎ উদ্দেশ্যকে সাবধানী বিষয়ী লোকেরা বাম্পের ন্যায় জ্ঞান করেন । কিন্তু এই বাষ্পের বলেই উন্নতির জাহাজ চলিতেছে। এই বাষ্পকে খাটাইতে হইবে, এই বায়ুকে পালে আটক করিতে হইবে । এমন তুমুল শক্তি আর কোথায় আছে ? আমাদের দেশে এই বাম্পের অভাব, বায়ুর অভাব । আমরা উন্নতির পালে একটুখানি ফু দিতেছি, যতখানি গাল ফুলিতেছে ততখানি পাল ফুলিতেছে না । বৃহৎ ভাবের নিকটে আত্মবিসর্জন করাকে যদি পাগলামি বলে, তবে সেই পাগলামি এক কালে প্রচুর পরিমাণে আমাদের ছিল । ইহাই প্রকৃত বীরত্ব | কর্তব্যের অনুরোধে রাম যে রাজ্য ছাড়িয়া বনে গেলেন তাহাই বীরত্ব, এবং সীতা ও লক্ষ্মণ যে তাহাকে অনুসরণ করিলেন তাহাও বীরত্ব । ভরত যে রামকে ফিরাইয়া আনিতে গেলেন তাহা বীরত্ব, এবং হনুমান যে প্ৰাণপণে রামের সেবা করিয়াছিলেন তাহাও বীরত্ব । হিংসা অপেক্ষা ক্ষমায় যে অধিক বীরত্ব, গ্রহণের অপেক্ষা ত্যাগে অধিক বীরত্ব, এই কথাই আমাদের কাব্যে ও শাস্ত্ৰে বলিতেছে। পালোয়ানিকে আমাদের দেশে সর্বাপেক্ষা বড়ো জ্ঞান করিত না । এইজন্য বাল্মীকির রাম রাবণকে পরাজিত করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, রাবণকে ক্ষমা করিয়াছেন । রাম রাবণকে দুইবার জয় করিয়াছেন। একবার বাণ মারিয়া, একবার ক্ষমা করিয়া । কবি বলেন, তন্মধ্যে শেষের জয়ই শ্রেষ্ঠ । হােমরের একিলিস পরাভূত হেক্টরের মৃতদেহ ঘোড়ার লেজে বাধিয়া শহর প্রদক্ষিণ করিয়াছিলেন— রামে একিলিসে তুলনা করো। যুরোপীয় মহাকবি হইলে পাণ্ডবদের যুদ্ধজয়েই মহাভারত শেষ করিতেন। কিন্তু আমাদের ব্যাস বলিলেন রাজ্য গ্রহণ করায় শেষ নহে, রাজ্য ত্যাগ করায় শেষ । যেখানে সব শেষ তাহাই আমাদের লক্ষ্য ছিল । কেবল তাহাই নহে, আমাদের কবিরা পুরস্কারেরও লোভ দেখান নাই। ইংরাজেরা য়ুটিলিটেরিয়ান, কতকটা দোকানদার ;