পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ԵrԳՀ রবীন্দ্র-রচনাবলী তাই তাহদের শাস্ত্ৰে পোয়েটিক্যাল জাস্টিস। --নামক একটা শব্দ আছে, তাহার অর্থ দেনাপাওনা, সৎকাজের দর-দাম করা । আমাদের সীতা চিরদুঃখিনী, রাম-লক্ষ্মণের জীবন দুঃখে কষ্টে শেষ হইল । এতবড়ো অর্জনের বীরত্ব কোথায় গেল ? অবশেষে দস্যদল আসিয়া তাহার নিকট হইতে যাদবরমণীদের কাড়িয়া লইয়া গেল, তিনি গাণ্ডীব তুলিতে পারিলেন না । পঞ্চপাণ্ডবের সমস্ত জীবন দারিদ্র্যে দুঃখে শোকে অরণ্যে কাটিয়া গেল, শেষেই বা কী সুখ পাইলেন । হরিশ্চন্দ্ৰ যে এত কষ্ট পাইলেন, এত ত্যাগ করিলেন, অবশেষে কবি তাহার কাছ হইতে পুণ্যের শেষ পুরস্কার স্বৰ্গও কাড়িয়া লাইলেন । ভীষ্ম যে রাজপুত্ৰ হইয়া সন্ন্যাসীর মতো জীবন কাটাইলেন, তাহার সমস্ত জীবনে সুখ কোথায় ! সমস্ত জীবন যিনি আত্মত্যাগের কঠিন শয্যায় শুইয়াছিলেন, মৃত্যুকালে তিনি শরশয্যায় বিশ্রাম লাভ করিলেন ! এক কালে মহৎ ভাবের প্রতি আমাদের দেশের লোকের এত বিশ্বাস এত নিষ্ঠা ছিল । তাহারা মহত্ত্বকেই মহত্ত্বের পরিণাম বলিয়া জানিতেন, ধর্মকেই ধর্মের পুরস্কার জ্ঞান করিতেন । আর আজকাল ! আজিকাল আমাদের এমনি হইয়াছে যে, কেরানিগিরি ছাড়া আর কিছুরই উপরে আমাদের বিশ্বাস নাই, এমন-কি, বাণিজ্যকেও পাগলামি জ্ঞান করি ! দরখাস্তকে ভবাসাগরের তরণী করিয়াছি, নাম সহি করিয়া আপনাকে বীর মনে করিয়া থাকি । আজ তোমাতে আমাতে ভাব হইল ভাই ! মহত্ত্বের একাল আর সেকাল কী ? যাহা ভালো তাহাই আমাদের হৃদয় গ্রহণ করুক, যেখানে ভালো সেখানেই আমাদের হৃদয় অগ্রসর হউক ! আমাদের লঘুতা চপলতা সংকীর্ণতা দূরে যাক ! অজ্ঞতা ও ক্ষুদ্রতা হইতে প্রসূত বাঙালিসূলভ অভিমানে মোটা হইয়া চক্ষু রুদ্ধ করিয়া আপনাকে সকলের চেয়ে বড়ো মনে না করি ও মহৎ হইবার আগে দেশকালপত্রনির্বিশেষে মহতের চরণের ধূলি লইতে পারি এমন বিনয় লাভ করি । আশীৰ্বাদক শ্ৰীষষ্ঠীচরণ দেবাশমণঃ V) শ্ৰীচরণেষু দাদামহাশয়, এবার কিছুদিন ভ্ৰমণে বাহির হইয়াছি। এই সুদূর বিস্তৃত মাঠ এই অশোকের ছায়ায় বসিয়া, আমাদের সেই কলিকাতা শহরকে একটা মস্ত ইটের খাচা বলিয়া মনে হইতেছে । শতসহস্ৰ মানুষকে একটা বড়ো খাচায় পুরিয়া কে যেন হাটে বিক্রয় করিতে আনিয়াছে। স্বভাবের গীত তুলিয়া বিকাইতে চাহি না । গাছপালা নাহিলে আমি তো বাচি না । আমি ষোলো আনা ‘ভেজিটেরিয়ান” । আমি কায়মনে উদ্ভিদ সেবন করিয়া থাকি । ইট-কাঠ চুন-সুরকি মৃত্যভাবের মতো আমার উপর চাপিয়া থাকে। হৃদয় পলে পলে মরিতে থাকে । বড়ো বড়ো ইমারতগুলো তাহাদের শক্ত শক্ত কড়ি বরগা মেলিয়া হা করিয়া আমাকে গিলিয়া ফেলে। প্ৰকাণ্ড কলিকাতাটার কঠিন জঠরের মধ্যে আমি যেন একেবারে হজম হইয়া যাই । কিন্তু এখানে এই গাছপালার মধ্যে প্ৰাণের হিল্লোল। হৃদয়ের মধ্যে যেখানে জীবনের সরোবর আছে, প্ৰকৃতির চারি দিক হইতে সেখানে জীবনের স্রোত আসিয়া মিশিতে থাকে । বঙ্গদেশ এখান হইতে কত শত ক্রোশ দূরে ! কিন্তু এখান হইতে বঙ্গভূমির এক নূতন মূর্তি দেখিতে পাইতেছি। যখন বঙ্গদেশের ভিতরে বাস করিতাম, তখন বঙ্গদেশের জন্য বড়ো আশা হইত না । তখন মনে হইত বঙ্গদেশ গোফে-তেল-গাছে-কঁঠালের দেশ। যতবড়ো-না-মুখ-ততবড়ো-কথার দেশ । পেটে-পিলে কানো-কলম ও মাথায়-শামলার দেশ । মনে হইত এখানে বিচিগুলাই দেখিতে দেখিতে