পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চিঠিপত্র Ե Գ Գ br শ্ৰীচরণেষু তবে আর কী ! তবে সমস্ত চুলায় যাক । বাংলাদেশ তাহার আম-কঁঠালের বাগান এবং বঁাশঝাড়ের মধ্যে বসিয়া কেবল ঘরকন্না করিতেই থাকুক। স্কুল উঠাইয়া দাও, সাপ্তাহিক এবং মাসিক সমুদয় কাগজপত্র বন্ধ করো, পৃথিবীর সকল বিষয় লইয়াই যে আন্দোলন-আলোচনা পড়িয়া গিয়াছে সেটা বলপূর্বক স্থগিত করো, ইংরাজি পড়া একেবারেই বন্ধ করো, বিজ্ঞান শিখিয়ো না, যে-সমস্ত মহাত্মা মানবজাতির জন্য আপনার জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন তাঁহাদের ইতিহাস পড়িয়ে না, পৃথিবীর যে-সকল মহৎ অনুষ্ঠান বাসুকির ন্যায় সহস্র শিরে মানবজাতিকে বিনাশবিশৃঙ্খলা হইতে রক্ষা করিয়া অটল উন্নতির পথে ধারণ করিয়া রাখিয়াছে, তাহাদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ হইয়া থাকে। অর্থাৎ, যাহাতে করিয়া হৃদয় জাগ্রত হয়, মনে উদ্যামের সঞ্চার হয়, বিশ্বের সঙ্গে মিলিত হইয়া একত্র কাজ করিবার জন্য অনিবাৰ্য আবেগ উপস্থিত হয়— সে সমস্ত হইতে দূরে থাকে। পড়িবার মধ্যে নূতন পঞ্জিকা পড়ো, কোন দিন বার্তাকু নিষেধ ও কোন দিন কুম্মাণ্ড বিধি তাহা লইয়া প্রতিদিন সমালোচনা করো । দালান ডাবাহঁকা নস্য ও নিন্দা লইয়া এই রৌদ্রতাপদগ্ধ নিদাঘ-মধ্যাহ্ন অতিবাহিত করে । সন্তানদের মাথার মধ্যে চাণক্যের শ্লোক প্ৰবেশ করাইয়া সেই মাথাগুলো ইহকাল ও পরকালের মতো ভক্ষণের জোগাড় করিয়া রাখে । দাদামহাশয়, তুমি কি সত্য-সত্যই বলিতেছ। আমরা একশত বৎসর পূর্বে যেরূপ ছিলাম অবিকল সেইরূপ থাকাই ভালো, আর কিছুমাত্র উন্নতি হইয়া কাজ নাই ? জ্ঞানলাভ করিয়া কাজ নাই, পাছে প্রবল জ্ঞানলালসা জন্মিয়া আমাদের দুর্বল দেহকে জীৰ্ণ করিয়া ফেলে ! লোকহিতপ্রবর্তক উপদেশ শুনিয়া কাজ নাই, পাছে মানবাহিতের জন্য কঠোর ব্ৰত পালন করিতে গিয়া এই প্রখর রৌদ্রতাপে আমরা শুষ্ক হইয়া যাই । বড়োলোকের জীবনবৃত্তান্ত পড়িয়া কাজ নাই, পাছে এই মশাকের দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াও আমাদের দুর্বল হৃদয়ে বড়োলোক হইবার দুরাশা জাগ্রত হয় ! তুমি পরামর্শ দিতেছ। ঠাণ্ডা হও, ছায়ায় থাকো, গৃহের দ্বার রুদ্ধ করো, ডাবের জল খাও, নাসারান্ধে তৈল দাও, এবং স্ত্রীপুত্রপরিবার ও প্রতিবেশীদিগকে লইয়া নিরুপদ্রবে সুখনিদ্রার আয়োজন করো ! কিন্তু এখন পরামর্শ দেওয়া বৃথা, সাবধান করা নিস্ফল । বাঁশির ধ্বনি কানে আসিয়াছে, আমরা গৃহের বাহির হইব । যে বন্ধনে আমরা সমস্ত মানবজাতির সহিত যুক্ত, সেই বন্ধনে আজ টান পড়িয়াছে। বৃহৎ মানব আমাদিগকে ডাকিয়াছে, তাহার সেবা করিতে না পারিলে আমাদের জীবন নিস্ফল । আমাদের পিতৃভক্তি, মাতৃভক্তি, সৌভ্রাত্র, বাৎসল্য, দাম্পত্যপ্ৰেম সমস্ত সে চাহিতেছে ; তাহাকে যদি বঞ্চিত করি তবে আমাদের সমস্ত প্রেম ব্যর্থ হয়, আমাদের হৃদয় অপরিতৃপ্ত থাকে । যেমন বালিকা স্ত্রী বয়ঃপ্ৰাপ্ত হইয়া ক্রমে যতই স্বামীপ্রেমের মর্ম অবগত হইতে থাকে, ততই তাহার হৃদয়ের সমুদয় প্রবৃত্তি স্বামীর অভিমুখিনী হইতে থাকে- তখন শরীরের কষ্ট, জীবনের ভয় বা কোনো উপদেশই তাহাকে স্বামীসেবা হইতে ফিরাইতে পারে না- তেমনি আমরা মানবপ্রেমের মর্ম অবগত হইতেছি, এখন আমরা মানবসেবায় জীবন উৎসগা করিব, কোনো দাদামশায়ের কোনো উপদেশ তাহা হইতে আমাদিগকে নিবৃত্ত করিতে পরিবে না। মরণ হয় তো মরিব, কোনো উপায় নাই। কী সুখেই বা বঁচিয়া আছি ! আনন্দের কথা বলিতেছ ? এই তো আনন্দ ! এই নূতন জ্ঞান, এই নূতন প্ৰেম, এই নূতন জীবনএই তো আনন্দ ! আনন্দের লক্ষণ কি কিছু ব্যক্ত হইতেছে না ! জাগরণের ভাব কি কিছু প্ৰকাশ পাইতেছে না ? বঙ্গসমাজের গঙ্গায় একটা জোয়ার আসিতেছে বলিয়া কি মনে হইতেছে না ! তাই কি সমাজের সর্বাঙ্গ আবেগে চঞ্চল হইয়া উঠে নাই ! আমাদের এ দেশ নিরানন্দের দেশ, আমাদের এ দেশে রোগ শোক তাপ আছে, রোগে শোকে নিরানন্দে আমরা জীৰ্ণ হইয়া মরিতে বসিয়াছিসেইজন্যই আমরা আনন্দ চাই, জীবন চাই- সেইজন্যই বলিতেছি নূতন স্রোত আসিয়া আমাদের