পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૧૪ রবীন্দ্র-রচনাবলী মুমূর্ষ হৃদয়ের স্বাস্থ্য বিধান করুক, মরিতেই যদি হয় তো যেন আনন্দের প্রভাবেই মরিতে পারি ! আর, মরিব কেন ! তুমি এমনি কি হিসাব জানাে যে, একবারে ঠিক দিয়া রাখিয়াছ যে আমরা মরিতেই বসিয়াছি! তোমার বুড়োমানুষের হিসাব-অনুযায়ী মনুষ্যসমাজ চলে না । তুমি কি জানো মানুষ সহসা কোথা হইতে বল পায়, কোথা হইতে দৈবশক্তি লাভ করে !! মনুষ্যসমােজ সাধারণত হিসাবে চলে বটে, কিন্তু এক-এক সময়ে সেখানে যেন ভেলকি লাগিয়া যায়, তখন আর হিসাবে মেলে না । অন্য সময়ে দুয়ে দুয়ে চার হয়, সহসা একদিন দুয়ে দুয়ে পােচ হইয়া যায়, তখন বুড়োমানুষেরা চক্ষু হইতে চশমা খুলিয়া অবাক হইয়া চাহিয়া থাকে । সহসা যখন নূতন ভাবের প্রবাহ উপস্থিত হইয়া জাতির হৃদয়ে আবর্ত রচনা করে তখনই সেই ভেলকি লাগিবার সময়-— তখন যে কী হইতে কী হয় ঠাহর পাইবার জো নাই । অতএব আমবাগানে আমাদের সেই ক্ষুদ্র নীড়ের মধ্যে আর ফিরিব না । হয় মরিব নয় বাচিব, এই কথাই ভালো । মরিবার ভয়ে বাচিয়া থাকিবার দরকার নাই। ক্রমওয়েল যখন প্ৰজাদলের দাসত্বরজজু ছেদন করিতেছিলেন তখন তিনি মরিতেও পারিতেন, বাচিতেও পারিতেন । ওয়াশিংটন যখন নূতন জাতির স্বাতন্ত্র্যের ধ্বজা উঠাইয়াছিলেন তখন তিনি মরিতেও পারিতেন, বাচিতেও পারিতেন ! পৃথিবীর সর্বত্রই এমন কেহ মরে কেহ বাচে— তাহাতে আপত্তি কী { দাদামশায়ের কোলের কাছে বসিয়া সমস্ত দিন উপকথা শুনিতে পারিব না । তোমার কি ভয় হয় পাছে তোমার বংশে বাতি দিবার কেহ না থাকে ! জিজ্ঞাসা করি— এখনই বা কে বাতি দিতেছে । সমস্তই যে অন্ধকার ! w বিদায় লইলাম দাদামহাশয় ! আমাদের আর চিঠিপত্ৰ চলিবে না । আমাদের কাজ করিবার বয়স । সংসারে কাজের বাধা যথেষ্ট আছে- পদে পদে বিঘ্নবিপত্তি, তাহার পরে বুড়োমানুষদের কােছ হইতে যদি নৈরাশ্য সঞ্চয় করিতে হয় তাহা হইলে যৌবন ফুরাইবার আগেই বৃদ্ধ হইতে হইবে । তাহা হইলে পঞ্চাশে পৌছবার পূর্বেই অরণ্যাশ্রম গ্রহণ করিতে হইবে । সম্মুখে আমাকে আহবান করিতেছে, আমি তোমার দিকে ফিরিয়া চাহিব না । তুমি বলিতেছ। ‘পথের মধ্যে খানা আছে, ডোবা আছে, সেইখানে পড়িয়া তুমি ঘাড় ভাঙিয়া মরিবে, অতএব ঘরের দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া বসিয়া থাকাই ভালো”— আমি তোমার কথায় বিশ্বাস করি না । আমি দুর্বল সত্য, কিন্তু তোমার উপদেশে আমি তো বল পাইতেছি না। আমার ব্ৰতপালনের পক্ষে আমি হীনবুদ্ধি বটে, কিন্তু তোমার উপদেশে আমি তো বুদ্ধি পাইতেছি না । অতএব আমার যেটুকু বল, যেটুকু বুদ্ধি আছে তাঁহাই সহায় করিয়া চলিলাম- মরিতে হয় তো চিরজীবনসমুদ্রে ঝাপ দিয়া মরিব । A সেবক শ্ৰীনবীনকিশোর শর্মণঃ চিরঞ্জীবেষু ভায়া, তোমার চিঠিতে কিঞ্চিৎ উষ্মা প্ৰকাশ পাইতেছে। তাহাতে আমি দুঃখিত নই। তোমাদের রক্তের তেজ আছে ; মাঝে মাঝে তোমরা যে গরম হইয়া উঠ, ইহা দেখিয়া আমাদের আনন্দ বোধ হয় । আমাদের মতো শীতল রক্ত যদি তোমাদের হইত। তাহা হইলে পৃথিবীর কাজ চলিত কী করিয়া ? তাহা হইলে ভূমণ্ডলের সর্বত্র মেরুপ্রদেশে পরিণত হইত। অনেক বুড়ো আছে বটে, তাহারা পৃথিবী হইতে যৌবনতাপ লোপ করিতে চায়, তাহাদের নিজ হৃদয়ের শৈত্য সর্বত্র সমভাবে ব্যাপ্ত হয় এই তাঁহাদের ইচ্ছা । যেখানে একটুমাত্ৰ তাত পাওয়া যায় সেইখানেই তাহারা অত্যন্ত ঠাণ্ডা ফু দিয়া সমস্ত জুড়াইয়া হিমা করিয়া দিতে চাহে। অর্থাৎ পৃথিবী হইতে