পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত - o OS কতকগুলি কলে-ছােটা কথা কহাইয়া গেলেই হইবে না ; তাহাকে চালাইতে হইবে, তাহাংে স্থান マ আমি কহিলাম— সেইটাই তো কঠিন । কথা শেষ করিয়া বুঝাইতে হইবে এখনো শেষ হয় নাই, কথার মধ্যে সেই উদ্যত ভঙ্গিটি দেওয়া বিষম ব্যাপার । স্রোতস্বিনী কহিল- এইজন্যই সাহিত্যে বহুকাল ধরিয়া একটা তর্ক চলিয়া আসিতেছে যে, বলিবার বিষয়টা বেশি, না, বলিবার ভঙ্গিটা বেশি। আমি এ কথাটা লইয়া অনেকবার ভাবিয়াছি, ভালো বুঝিতে পারি না । আমার মনে হয় তর্কের খেয়াল অনুসারে যখন যেটাকে প্রাধান্য দেওয়া যায়। তখন সেইটাই প্রধান হইয়া উঠে । । ব্যোম মাথাটা কড়িকাঠের দিকে তুলিয়া বলিতে লাগিল- সাহিত্যে বিষয়টা শ্রেষ্ঠ, না, ভঙ্গিটা শ্রেষ্ঠ ইহা বিচার করিতে হইলে আমি দেখি, কোনটা অধিক রহস্যময়। বিষয়টা দেহ, ভঙ্গিটা জীবন । দেহটা বর্তমানেই সমাপ্ত ; জীবনটা একটা চঞ্চল অসমাপ্তি তাহার সঙ্গে লাগিয়া আছে, তাহাকে বৃহৎ ভবিষ্যতের দিকে বহন করিয়া লইয়া চলিয়াছে ; সে যতখানি দৃশ্যমান তাহা অতিক্রম করিয়াও তাহার সহিত অনেকখানি আশাপূর্ণ নব নব সম্ভাবনা জুড়িয়া রাখিয়াছে। যতটুকু বিষয়রপে প্রকাশ করিলে ততটুকু জড় দেহ মাত্র, ততটুকু সীমাবদ্ধ ; যতটুকু ভঙ্গির দ্বারা তাহার মধ্যে সঞ্চার করিয়া দিলে তাঁহাই জীবন, তাহাতেই তাহার বৃদ্ধিশক্তি, তাহার চলৎশক্তি সূচনা করিয়া দেয় । সমীর কহিল— সাহিত্যের বিষয়মাত্রই অতি পুরাতন, আকার গ্রহণ করিয়া সে নূতন হইয়া উঠে । স্রোতস্বিনী কহিল— আমার মনে হয় মানুষের পক্ষেও ঐ একই কথা । এক-এক জন মানুষ এমন একটি মনের আকৃতি লইয়া প্ৰকাশ পায় যে, তাহার দিকে চাহিয়া আমরা পুরাতন মনুষ্যত্বের যেন একটা নূতন বিস্তার আবিষ্কার করি । দীপ্তি কহিল- মনের এবং চরিত্রের সেই আকৃতিটাই আমাদের স্টাইল । সেইটের দ্বারাই আমরা পরস্পরের নিকট প্রচলিত পরিচিত পরীক্ষিত হইতেছি। আমি এক-এক বার ভাবি আমার স্টাইলটা কী রকমের । সমালোচকেরা যাহাকে প্ৰাঞ্জল বলে, তাহা নহে-- সমীর কহিল— কিন্তু ওজস্বী বটে । তুমি যে আকৃতির কথা কহিলে, যেটা বিশেষরূপে আমাদের আপনার, আমিও তাঁহারই কথা বলিতেছিলাম। চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে চেহারাখানা যাহাতে বজায় থাকে আমি সেই অনুরোধ করিতেছিলাম । দীপ্তি ঈষৎ হাসিয়া কহিল- কিন্তু চেহারা সকলের সমান নহে, অতএব অনুরোধ করিবার পূর্বে বিশেষ বিবেচনা করা আবশ্যক । কোনো চেহারায় বা প্ৰকাশ করে, কোনো চেহারায় বা গোপন করে । হীরকের জ্যোতি হীরকের মধ্যে স্বতঃই প্ৰকাশমান, তাহার আলো বাহির করিবার জন্য তাহার চেহারা ভাঙিয়া ফেলিতে হয় না, কিন্তু তৃণকে দগ্ধ করিয়া ফেলিলে তবেই তাহার আলোকটুকু বাহির হয়। আমাদের মতো ক্ষুদ্র প্রাণীর মুখে এ বিলাপ শোভা পায় না যে, সাহিত্যে আমাদের চেহারা বজায় থাকিতেছে না । কেহ কেহ আছে কেবল যাহার অস্তিত্ব, যাহার প্রকৃতি, যাহার সমগ্র সমষ্টি আমাদের কাছে একটি নূতন শিক্ষা, নূতন আনন্দ । সে যেমনটি তাহাকে তেমনি অবিকল রক্ষা করিতে পারিলেই যথেষ্ট । কেহ বা আছে যাহাকে ছড়াইয়া ফেলিয়া ভিতর হইতে শাস বাহির করিতে হয় । শাসটুকু যদি বাহির হয় তবে সেইজন্যই কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত, কারণ, তাহাই বা কয়জন লোকের আছে এবং কয়জন বাহির করিয়া দিতে পারে । সমীর হাস্যমুখে কহিল- মাপ করিবেন দীপ্তি, আমি যে তৃণ এমন দীনতা আমি কখনো স্বপ্নেও অনুভব করি না। বরঞ্চ অনেক সময় ভিতর দিকে চাহিলে আপনাকে খনির হীরক বলিয়া অনুমান হয় । এখন কেবল চিনিয়া লইতে পারে এমন একটা জহরির প্রত্যাশায় বসিয়া আছি। ক্রমে যত দিন যাইতেছে তত আমার বিশ্বাস হইতেছে- পৃথিবীতে জহরের তত অভাব নাই যত জহরির। তরুণ বয়সে সংসারে মানুষ চোখে পড়িত না, মনে হইত। যথার্থ মানুষগুলা উপন্যাস নাটক এবং মহাকাব্যেই