পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত &S)(2 বাধি মাত্র। ঐ খেলাটার উপলক্ষ করিয়া জ্ঞানসমুদ্র হইতে খানিকটা সমুদ্রের হাওয়া খাইয়া আসা আমাদের উদ্দেশ্য | রত্ন লইয়া আসি না, খানিকটা স্বাস্থ্য লইয়া আসি, তাহার পর সে বালির ঘর ভাঙে কি থাকে তাহাতে কাহারও কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। । রত্ন অপেক্ষা স্বাস্থ্য যে কম বহুমূল্য আমি তাহা মনে করি না। রত্ন অনেক সময় কুঁটা প্রমাণ হয়, কিন্তু স্বাস্থ্যকে স্বাস্থ্য ছাড়া আর-কিছু বলিবার জো নাই। আমরা পাঞ্চভৌতিক সভার পঁাচ ভূতে মিলিয়া। এ-পর্যন্ত একটা কানাকড়ি দামের সিদ্ধান্তও সংগ্ৰহ করিতে পারিয়াছি কি না সন্দেহ, কিন্তু, তবু যতবার আমাদের সভা বসিয়াছে আমরা শূন্যহন্তে ফিরিয়া আসিলেও আমাদের সমস্ত মনের মধ্যে যে সবেগে রক্তসঞ্চালন হইয়াছে এবং সেজন্য আনন্দ এবং আরোগ্য লাভ করিয়াছি তাহাতে সন্দেহমাত্র নাই । te গড়ের মাঠে এক ছটাক শস্য জন্মে না, তবু অতটা জমি অনাবশ্যক নহে। আমাদের পাঞ্চভৌতিক সভাও আমাদের পাচজনের গড়ের মাঠ, এখানে সত্যের শস্যলাভ করিতে আসি না, সত্যের আনন্দলাভ করিতে মিলি । সেইজন্য এ সভায় কোনো কথার পুরা মীমাংসা না হইলেও ক্ষতি নাই, সত্যের কিয়দংশ পাইলেও আমাদের চলে। এমন-কি, সত্যক্ষেত্ৰ গভীররূপে কৰ্ষণ না করিয়া তাহার উপর দিয়া লঘুপদে চলিয়া যাওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য । আর-এক দিক হইতে আর-এক রকমের তুলনা দিলে কথাটা পরিষ্কার হইতে পারে। রোগের সময় ডাক্তারের ঔষধ উপকারী, কিন্তু আত্মীয়ের সেবাটা বড়ো আরামের । জার্মান পণ্ডিতের কেতবে তত্ত্বজ্ঞানের যে-সকল চরম সিদ্ধান্ত আছে তাহাকে ঔষধের বটিকা বলিতে পারো, কিন্তু মানসিক শুশ্রুষা তাহার মধ্যে নাই । পাঞ্চভৌতিক সভায় আমরা যেভাবে সত্যালোচনা করিয়া থাকি তাহাকে রোগের চিকিৎসা বলা না যাক, তাহাকে রোগীর শুশ্রুষা বলা যাইতে পারে। আর অধিক তুলনা প্রয়োগ করিব না। মোট কথা এই, সেদিন আমরা চার বুদ্ধিমানে মিলিয়া হাসি সম্বন্ধে যে-সকল কথা তুলিয়াছিলাম তাহার কোনোটাই শেষ কথা নহে। যদি শেষ কথার দিকে যাইবার চেষ্টা করিতাম তাহা হইলে কথোপকথনসভার প্রধান নিয়ম লঙঘন করা হইত । কথোপকথনসভার একটি প্রধান নিয়ম- সহজে এবং দ্রুতবেগে অগ্রসর হওয়া । অর্থাৎ মানসিক পায়চারি করা । আমাদের যদি পদতল না থাকিত, দুই পা যদি দুটাে তীক্ষাগ্ৰ শলাকার মতো হইত, তাহা হইলে মাটির ভিতর দিকে সুগভীর ভাবে প্রবেশ করার সুবিধা হইত, কিন্তু এক পা অগ্রসর হওয়া সহজ হইত না । কথোপকথনসমাজে আমরা যদি প্রত্যেক কথার অংশকে শেষ পর্যন্ত তলাইবার চেষ্টা করিতাম তাহা হইলে একটা জায়গাতেই এমন নিরুপায়ভাবে বিদ্ধ হইয়া পড়া যাইত যে, আর চলাফেরার উপায় থাকিত না । এক-একবার এমন অবস্থা হয়, চলিতে চলিতে হঠাৎ কাদার মধ্যে গিয়া পড়ি ; সেখানে যেখানেই পা ফেলি হাঁটু পর্যন্ত বসিয়া যায়, চলা দায় হইয়া উঠে । এমন-সকল বিষয় আছে যাহাতে প্ৰতি পদে গভীরতার দিকে তলাইয়া যাইতে হয় ; কথোপকথনকালে সেই-সকল অনিশ্চিত সন্দেহতরল বিষয়ে পদার্পণ না করাই ভালো । সে-সব জমি বায়ুসেবী পর্যটনকারীদের উপযোগী নহে, কৃষি যাহাদের ব্যবসায় তাহাদের পক্ষেই ভালো । যাহা হউক, সেদিন মােটের উপরে আমরা প্রশ্নটা এই তুলিয়াছিলাম যে, যেমন দুঃখের কান্না, । তেমনি সুখের হাসি আছে- কিন্তু মাঝে হইতে কৌতুকের হাসিটা কোথা হইতে আসিল ? কৌতুক জিনিসটা কিছু রহস্যময় । জন্তুরাও সুখ দুঃখ অনুভব করে, কিন্তু কৌতুক অনুভব করে না । অলংকারশাস্ত্রে যে-কটা রসের উল্লেখ আছে সব রসই জন্তুদের অপরিণত অপরিস্ফুট সাহিত্যের মধ্যে আছে, কেবল হাস্যরসটা নাই। হয়তো বানরের প্রকৃতির মধ্যে এই রসের কথঞ্চিৎ আভাস দেখা যায়, যাহা অসংগত তাহাতে মানুষের দুঃখ পাওয়া উচিত ছিল, হাসি পাইবার কোনো অর্থই নাই । পশ্চাতে যখন চৌকি নাই তখন চৌকিতে বসিতেছি মনে করিয়া কেহ যদি মাটিতে পডিয়া যায়। তবে