পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত S86 ব্যোম কহিল- আজিকার এই বঁাশি শুনিতে শুনিতে একটা কথা বিশেষ করিয়া আমার মনে উদয় হইতেছে। প্রত্যেক কবিতার মধ্যে একটি বিশেষ রস থাকে- অলংকারশাস্ত্ৰে যাহাকে আদি করুণ শান্তি -নামক ভিন্ন ভিন্ন নামে ভাগ করিয়াছে ; আমার মনে হইতেছে, জগৎরচনাকে যদি কাব্যহিসাবে দেখা যায়। তবে মৃত্যুই তাহার সেই প্রধান রস, মৃত্যুই তাহাকে যথার্থ কবিত্ব অর্পণ করিয়াছে। যদি মৃত্যু না থাকিত, জগতের যেখানকার যাহা তাহা চিরকাল সেইখানেই যদি অবিকৃত ভাবে দাড়াইয়া থাকিত, তবে জগৎটা একটা চিরস্থায়ী সমাধিমন্দিরের মতো অত্যন্ত সংকীর্ণ, অত্যন্ত কঠিন, অত্যন্ত বদ্ধ হইয়া । রহিত । এই অনন্ত নিশ্চলতার চিরস্থায়ী ভার বহন করা প্রাণীদের পক্ষে বড়ো দুরূহ হইত। মৃত্যু এই অস্তিত্বের ভীষণ ভারকে সর্বদা লঘু করিয়া রাখিয়াছে, এবং জগৎকে বিচরণ করিবার অসীম ক্ষেত্র দিয়াছে। যে দিকে মৃত্যু সেই দিকেই জগতের অসীমতা । সেই অনন্ত রহস্যভূমির দিকেই মানুষের সমস্ত কবিতা, সমস্ত সংগীত, সমস্ত ধৰ্মতন্ত্র, সমস্ত তৃপ্তিহীন বাসনা সমুদ্রপারগামী পক্ষীর মতো নীড় অন্বেষণে উড়িয়া চলিয়াছে। একে, যাহা প্ৰত্যক্ষ, যুগুহা বর্তমান, তাহা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত প্রবল, আবার তাঁহাই যদি চিরস্থায়ী হইত। তবে তাহার একেশ্বর দীেরাত্ম্যের আর শেষ থাকিত না— তবে তাহার উপরে আর আপিল চলিত কোথায় ? তবে কে নির্দেশ করিয়া দিত ইহার বাহিরেও অসীমতা আছে ? অনন্তের ভার এ জগৎ কেমন করিয়া বহন করিত মৃত্যু যদি সেই অনন্তকে আপনার চিরপ্রবাহে নিত্যকাল ভাসমান করিয়া না। রাখিত ? সমীর কহিল- মরিতে না হইলে বাচিয়া থাকিবার কোনো মর্যাদাই থাকিত না । এখন জগৎসুদ্ধ লোক যাহাকে অবজ্ঞা করে সেও মৃত্যু আছে বলিয়াই জীবনের গৌরবে গৌরবান্বিত । ক্ষিতি কহিল— আমি সেজন্য বেশি চিন্তিত নহি ; আমার মতে মৃত্যুর অভাবে কোনো বিষয়ে কোথাও দাড়ি দিবার জো থাকিত না সেইটাই সব চেয়ে চিন্তার কারণ । সে অবস্থায় ব্যোম যদি অদ্বৈততত্ত্ব সম্বন্ধে আলোচনা উত্থাপন করিত কেহ জোড়হাত করিয়া এ কথা বলিতে পারিত না যে, ভাই, এখন আর সময় নাই, অতএব ক্ষান্ত হও । মৃত্যু না থাকিলে অবসরের অন্ত থাকিত না । এখন মানুষ নিদেন সাত-আট বৎসর বয়সে অধ্যয়ন আরম্ভ করিয়া পঁচিশ বৎসর বয়সের মধ্যে কলেজের ডিগ্রি লইয়া অথবা দিব্য ফেল করিয়া নিশ্চিন্ত হয় ; তখন কোনো বিশেষ বয়সে আরম্ভ করারও কারণ থাকিত না, কোনো বিশেষ বয়সে শেষ করিবারও তাড়া থাকিত না । সকলপ্রকার কাজকর্ম ও জীবনযাত্রার কম সেমিকোলন দাড়ি একেবারেই উঠিয়া যাইত । ব্যোম এ-সকল কথায় যথেষ্ট কৰ্ণপাত না করিয়া নিজের চিন্তাসূত্র অনুসরণ করিয়া বলিয়া গেলজগতের মধ্যে মৃত্যুই কেবল চিরস্থায়ী— সেইজন্য আমাদের সমস্ত চিরস্থায়ী আশা ও বাসনাকে সেই মৃত্যুর মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি। আমাদের স্বৰ্গ, আমাদের পুণ্য, আমাদের অমরতা সব সেইখানেই । যে-সব জিনিস আমাদের এত প্ৰিয় যে, কখনো তাহাদের বিনাশ কল্পনাও করিতে পারি না, সেগুলিকে মৃত্যুর হস্তে সমর্পণ করিয়া দিয়া জীবনান্ত কাল অপেক্ষা করিয়া থাকি। পৃথিবীতে বিচার নাই, সুবিচার মৃত্যুর পরে ; পৃথিবীতে প্ৰাণপণ বাসনা নিস্ফল হয়, সফলতা মৃত্যুর কল্পতরুতলে । জগতের অসীমতাকে অপ্রমাণ করে- জগতের যে সীমায় মৃত্যু, যেখানে সমস্ত বস্তুর অবসান, সেইখানেই আমাদের প্ৰিয়তম প্রবলতম বাসনার, আমাদের শুচিতম সুন্দরতম কল্পনার, কোনো প্রতিবন্ধক নাই । আমাদের শিব শ্মশানবাসী- আমাদের সর্বোচ্চ মঙ্গলের আদর্শ মৃত্যুনিকেতনে । মুলতান-বারোয়া শেষ করিয়া সূর্যস্তকালের স্বর্ণভি অন্ধকারের মধ্যে নহবতে পূরবী বাজিতে লাগিল । সমীর বলিল— মানুষ মৃত্যুর পারে যে-সকল আশা-আকাঙক্ষাকে নির্বাসিত করিয়া দিয়াছে, আনিতেছে। সাহিত্য এবং সংগীত এবং সমস্ত ললিতকলা, মনুষ্যহাদয়ের সমস্ত নিত্য পদার্থকে মৃত্যুর পরকালপ্রান্ত হইতে ইহজীবনের মাঝখানে আনিয়া প্রতিষ্ঠিত করিতেছে। বলিতেছে, পৃথিবীকে স্বৰ্গ, বাস্তবকে সুন্দর এবং এই ক্ষণিক জীবনকেই অমর করিতে হইবে । মৃত্যু যেমন জগতের অসীম রূপ SVO