পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ S〉○ কৌতুকপ্রিয়তা জড়িত ছিল। বৃদ্ধকে শুদ্ধমাত্র নিপীড়ন করা আমার দ্বারা সম্ভব হইত না ; কিন্তু একদিন হঠাৎ এমন একটা কৌতুকাবহ প্ল্যান মাথায় উদয় হইল যে, সেটা কাজে খাটাইবার প্রলোভন সম্বরণ করিতে পারিলাম না । পূর্বেই বলিয়াছি, বৃদ্ধকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য নানা লোকে নানা মিথ্যা কথার স্বজন করিত। পাড়ার একজন পেনসনভোগী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট প্রায় বলিতেন, “ঠাকুরদা, ছোটোলাটের সঙ্গে যখনই দেখা হয় তিনি নয়নজোড়ের বাবুদের খবর না নিয়ে ছাড়েন না— সাহেব বলেন, বাংলাদেশে, বর্ধমানের রাজা এবং নয়নজোড়ের বাবু, এই দুটি মাত্র যথার্থ বনেদি বংশ আছে।” ঠাকুরদা ভারি খুশি হইতেন এবং ভূতপূর্ব ডেপুটিবাবুর সহিত সাক্ষাৎ হইলে অন্যান্ত কুশলসংবাদের সহিত জিজ্ঞাসা করিতেন, “ছোটোলাট সাহেব ভালো আছেন ? র্তার মেমসাহেব ভালো আছেন? তার পুত্রকন্যারা সকলেই ভালো আছেন ? সাহেবের সহিত শীঘ্র একদিন সাক্ষাৎ করিতে যাইবেন এমন ইচ্ছাও প্রকাশ করিতেন । কিন্তু ভূতপূর্ব ডেপুটি নিশ্চয়ই জানিতেন, নয়নজোড়ের বিখ্যাত চৌধুড়ি প্রস্তুত হইয়া দ্বারে অসিতে আসিতে বিস্তর ছোটোলাট এবং বড়োলাট বদল হইয়া যাইবে । আমি একদিন প্রাতঃকালে গিয়া কৈলাসবাবুকে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া চুপিচুপি বলিলাম, "ঠাকুরদা, কাল লেপ্টেনেণ্ট গবর্নরের লেভিতে গিয়েছিলুম। তিনি নয়নজোড়ের বাবুদের কথা পাড়াতে আমি বললুম, নয়নজোড়ের কৈলাসবাবু কলকাতাতেই আছেন ; শুনে, ছোটোলাট এতদিন দেখা করতে আসেন নি বলে ভারি দুঃখিত হলেন— বলে দিলেন, আজই দুপুরবেলা তিনি গোপনে তোমার সঙ্গে সাক্ষাং করতে আসবেন ।” আর কেহ হইলে কথাটার অসম্ভবত বুঝিতে পারিত এবং আর-কাহারো সম্বন্ধে হইলে কৈলাসবাবুও এ কথায় হাস্ত করিতেন কিন্তু নিজের সম্বন্ধীয় বলিয়া এ সংবাদ র্তাহার লেশমাত্র অবিশ্বাস্ত বোধ হইল না। শুনিয়া যেমন খুশি হইলেন তেমনি অস্থির হইয়া উঠিলেন– কোথায় বসাইতে হইবে, কী করিতে হইবে, কেমন করিয়া অভ্যর্থনা করিবেন, কী উপায়ে নয়নজোড়ের গৌরব রক্ষিত হইবে, কিছুই ভাবিয়া পাইলেন না । তাহা ছাড়া তিনি ইংরাজি জানেন না, কথা চালাইবেন কী করিয়া সেও এক সমস্ত । আমি বলিলাম, “সেজন্য ভাবনা নাই, তাহার সঙ্গে একজন করিয়া দোভাষী থাকে ; কিন্তু ছোটোলাট-সাহেবের বিশেষ ইচ্ছা, আর কেহ উপস্থিত না থাকে।”