পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ९२S দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ যাহারা শাস্তভাবে সহ করে তাহারা গভীরতররূপে আহত হয় ; অপমানের আঘাত ইন্দ্রাণী যদিও অসীম অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করিয়াছিল, তথাপি তাছা তাহার অন্তরে বাজিয়াছিল । ইন্দ্রাণীর সহিত যেমন বিনোদবিহারীর বিবাহের প্রস্তাব হইয়াছিল তেমনি এক সময় ইন্দ্রাণীর এক দূরসম্পর্কের নিঃস্ব পিসতুতো ভাই বামাচরণের সহিত নয়নতারার বিবাহের কথা হয়, সেই বামাচরণ এখন বিনোদের সেরেস্তায় একজন সামান্য কর্মচারী। ইন্দ্রাণীর এখনো মনে পড়ে, বাল্যকালে একদিন নয়নতারার বাপ নয়নকে সঙ্গে করিয়া র্তাহীদের বাড়িতে আসিয়া বামাচরণের সহিত র্তাহার কন্যার বিবাহের জন্য গৌরীকাস্তকে বিস্তর অনুনয়-বিনয় করিয়াছিলেন। সেই উপলক্ষে ক্ষুদ্র বালিকা নয়নতারার অসামান্ত প্ৰগলভতায় গৌরীকাস্তের অন্তঃপুরে সকলেই আশ্চর্য এবং কৌতুকান্বিত হইয়াছিলেন এবং তাহার সেই অকালপকতার নিকট মুখচোরা লাজুক ইন্দ্রাণী নিজেকে নিতান্ত অক্ষমা অনভিজ্ঞ জ্ঞান করিয়াছিল। গৌরীকান্ত এই মেয়েটির অনর্গল কথায়বার্তায় এবং চেহারায় বড়োই খুশি হইয়াছিলেন, কিন্তু কুলের যৎকিঞ্চিৎ ক্রটি থাকায় বামাচরণের সহিত ইহার বিবাহপ্রস্তাবে মত দিলেন না। অবশেষে তাহারই পছন্দে এবং তাহারই চেষ্টায় অকুলীন বিনোদের সহিত নয়নতারার বিবাহ হয়। এই-সকল কথা মনে করিয়া ইন্দ্রাণী কোনো সাত্বনা পাইল না, বরং অপমান আরো বেশি করিয়া বাজিতে লাগিল। মহাভারতে বর্ণিত শুক্রাচার্যদুহিতা দেবযানী এবং শৰ্মিষ্ঠার কথা মনে পড়িল । দেবযানী যেমন তাহার প্রভুকন্যা শৰ্মিষ্ঠার দর্প চূর্ণ করিয়া তাহাকে দাসী করিয়াছিল, ইন্দ্রাণী যদি তেমনি করিতে পারিত তবেই যথোপযুক্ত বিধান হইত। এক সময় ছিল, যখন দৈত্যদের নিকট দৈত্যগুরু শুক্রাচার্ধের ন্যায় মুকুন্দবাবুর পরিবারবর্গের নিকট তাহার পিতামহ গৌরীকান্ত একান্ত আবশুক ছিলেন। তখন তিনি যদি ইচ্ছা করিতেন তবে মুকুন্দবাবুকে হীনতা স্বীকার করাইতে পারিতেন। কিন্তু তিনিই মুকুন্দলালের বিষয়সম্পত্তিকে উন্নতির চরম সীমায় উত্তীর্ণ করিয়া দিয়া সর্বপ্রকার শৃঙ্খলা স্থাপন করিয়া গিয়াছেন, অতএব আজ আর র্তাহাকে স্মরণ করিয়া প্রভুদের কৃতজ্ঞ হইবার আবশ্বকতা নাই। ইন্দ্রাণী মনে করিল, বাকাগাড়ি পরগনা তাহার পিতামহ অনায়াসে মিজের জন্যই কিনিতে পারিতেন, তখন র্তাহার সে ক্ষমত জন্মিয়াছিল, তাহা না করিয়া তিনি সেটা মনিবকে কিনিয়া দিলেন— ইহা যে একপ্রকার দান করা সে কথা কি আজ সেই মলিবের বংশে কেহ মনে করিয়া রাখিয়াছে।