পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৩৪ রবীন্দ্র-রচনাবলী গীয়ে জল ছুড়িয়া মারিতেছে, এবং সস্তরণকারিণীদের পদাঘাতে জলবিন্দুরাশি মুক্তামুষ্টির মতো আকাশে ছিটিয়া পড়িতেছে । আমার বক্ষের মধ্যে একপ্রকার কম্পন হইতে লাগিল ; সে উত্তেজনা ভয়ের কি আনন্দের কি কৌতুহলের, ঠিক বলিতে পারি না। বড়ো ইচ্ছা হইতে লাগিল ভালো করিয়া দেখি, কিন্তু সম্মুখে দেখিবার কিছুই ছিল না ; মনে হইল ভালো করিয়া কান পাতিলেই উহাদের কথা সমস্তই স্পষ্ট শোনা যাইবে, কিন্তু একান্তমনে কান পাতিয়া কেবল অরণ্যের ঝিল্লিরব শোনা যায়। মনে হইল, আড়াই শত বৎসরের কৃষ্ণবর্ণ যবনিক ঠিক আমার সম্মুখে দুলিতেছে— ভয়ে ভয়ে একটি ধার তুলিয়া ভিতরে দৃষ্টিপাত করি— সেখানে বৃহৎ সভা বসিয়াছে, কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না । হঠাৎ গুমট ভাঙিয়া হু হু করিয়া একটা বাতাস দিল— শুস্তার স্থির জলতল দেখিতে দেখিতে অঙ্গরীর কেশদামের মতে কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, এবং সন্ধ্যাছায়াচ্ছন্ন সমস্ত বনভূমি এক মুহূর্তে একসঙ্গে মৰ্মরধ্বনি করিয়া যেন দুঃস্বপ্ন হইতে জাগিয়া উঠিল । স্বপ্নই বল আর সত্যই বল, আড়াই শত বৎসরের অতীত ক্ষেত্র হইতে প্রতিফলিত হইয়া আমার সম্মুখে যে এক অদৃশ্ব মরীচিকা অবতীর্ণ হইয়াছিল তাহা চকিতের মধ্যে অন্তৰ্হিত হইল । যে মায়াময়ীরা আমার গায়ের উপর দিয়া দেহহীন দ্রুতপদে শব্দহীন উচ্চকলহাস্তে ছুটিয়া শুস্তার জলের উপর গিয়া বাপ দিয়া পড়িয়াছিল তাহারা সিক্ত অঞ্চল হইতে জল নিষ্কর্ষণ করিতে করিতে আমার পাশ দিয়া উঠিয়া গেল না । বাতাসে যেমন করিয়া গন্ধ উড়াইয়া লইয়া যায়, বসন্তের এক নিশ্বাসে তাহারা তেমনি করিয়া উড়িয়া চলিয়া গেল । তখন আমার বড়ো আশঙ্কা হইল যে, হঠাৎ বুঝি নির্জন পাইয়া কবিতাদেবী আমার স্বন্ধে আসিয়া ভর করিলেন ; আমি বেচারা তুলার মাশুল আদায় করিয়া খাটিয়া খাই, সর্বনাশিনী এইবার বুঝি আমার মুগুপাত করিতে আসিলেন। ভাবিলাম, ভালো করিয়া আহার করিতে হইবে ; শূন্ত উদরেই সকল প্রকার দুরারোগ্য রোগ আলিয়া চাপিয়া ধরে। আমার পাচকটিকে ডাকিয়া প্রচুরত্বতপক মসলা-স্বৰ্গন্ধি রীতিমত মোগলাই খান হুকুম করিলাম । পরদিন প্রাতঃকালে সমস্ত ব্যাপারটি পরম হাস্যজনক বলিয়া বোধ হইল। আনন্দমনে সাহেবের মতো সোলাটুপি পরিয়া, নিজের হাতে গাড়ি হাকাইয়া, গড় গড় শব্দে আপন তদন্তকার্ধে চলিয়া গেলাম। সেদিন ত্রৈমাসিক রিপোর্ট লিখিবার দিন থাকাতে বিলম্বে বাড়ি ফিরিবার কথা । কিন্তু সন্ধ্যা হইতে না হইতেই আমাকে বাড়ির দিকে টানিতে লাগিল । কে টানিতে লাগিল বলিতে পারি না ; কিন্তু মনে হইল, আর বিলম্ব করা