পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ २७¢ উচিত হয় না। মনে হইল, সকলে বসিয়া আছে। রিপোর্ট, অসমাপ্ত রাখিয়া সোলার টুপি মাথায় দিয়া সেই সন্ধ্যাধুসর তরুচ্ছায়াঘন নির্জন পথ রথচক্রশব্দে সচকিত করিয়া সেই অন্ধকার শৈলান্তবর্তী নিস্তব্ধ প্রকাণ্ড প্রাসাদে গিয়া উত্তীর্ণ হইলাম। সিড়ির উপরে সম্মুখের ঘরটি অতি বৃহৎ । তিন সারি বড়ে বড়ো থামের উপর কারুকার্যখচিত খিলানে বিস্তীর্ণ ছাদ ধরিয়া রাখিয়াছে। এই প্রকাণ্ড ঘরটি আপনার বিপুল শূন্ততাভরে অহৰ্নিশি গম গম্‌ করিতে থাকে। সেদিন সন্ধ্যার প্রাকালে তখনো প্রদীপ জালানো হয় নাই। দরজা ঠেলিয়া আমি সেই বৃহৎ ঘরে যেমন প্রবেশ করিলাম অমনি মনে হইল ঘরের মধ্যে যেন ভারি একটা বিপ্লব বাধিয়া গেল— যেন হঠাৎ সভা ভঙ্গ করিয়া চারি দিকের দরজা জানলা ঘর পথ বারান্দা দিয়া কে কোন দিকে পলাইল তাহার ঠিকানা নাই। আমি কোথাও কিছু না দেখিতে পাইয়া অবাক হইয়া দাড়াইয়া রছিলাম। শরীর একপ্রকার আবেশে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। যেন বহুদিবসের লুপ্তাবশিষ্ট মাথাঘষা ও আতরের মুদু গন্ধ আমার নাসার মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। আমি সেই দীপহীন জনহীন প্রকাণ্ড ঘরের প্রাচীন প্রস্তরস্তম্ভশ্রেণীর মাঝখানে দাড়াইয়া শুনিতে পাইলাম— ঝঝর শব্দে ফোয়ারার জল সাদা পাথরের উপরে আসিয়া পড়িতেছে, সেতারে কী স্থর বাজিতেছে বুঝিতে পারিতেছি না, কোথাও বা স্বর্ণভূষণের শিঞ্জিত, কোথাও বা নূপুরের নিকণ, কখনো বা বৃহৎ তাম্ৰঘণ্টায় প্রহর বাজিবার শব্দ, অতি দূরে নহবতের আলাপ, বাতাসে দোদুল্যমান ঝাড়ের স্ফটিকদোলকগুলির ঠন্‌ ঠন ধ্বনি, বারান্দা হইতে খাচার বুলবুলের গান, বাগান হইতে পোষা সারসের ডাক আমার চতুর্দিকে একটা প্রেতলোকের রাগিণী হষ্টি করিতে লাগিল । আমার এমন একটা মোহ উপস্থিত হইল, মনে হইল, এই অস্পৃশু অগম্য অবাস্তব ব্যাপারই জগতে একমাত্র সত্য ; আর সমস্তই মিথ্যা মরীচিকা । আমি যে আমি— অর্থাৎ আমি যে শ্ৰীযুক্ত অমুক, yঅমুকের জ্যেষ্ঠ পুত্র, তুলার মাশুল সংগ্ৰহ করিয়া সাড়ে চার-শো টাকা বেতন পাই, আমি যে সোলার টুপি এবং খাটো কোর্তা পরিয়া টমটম্ হাকাইয়া আপিল করিতে যাই, এ-সমস্তই আমার কাছে এমন অদ্ভুত হাস্যকর অমূলক মিথ্যা কথা বলিয়া বোধ হইল যে, আমি সেই বিশাল নিস্তব্ধ অন্ধকার ঘরের মাঝখানে দাড়াইয়া হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিলাম । তখনই আমার মুসলমান ভৃত্য প্রজ্জ্বলিত কেরোলিন ল্যাম্প হাতে করিয়া ঘরের মধ্যে । প্রবেশ করিল। সে আমাকে পাগল মনে করিল কি না জানি না, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আমার স্মরণ হইল যে, আমি ৬অমুকচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্ৰীযুক্ত অমুকনাথ বটে ; ইহাও মনে করিলাম যে, জগতের ভিতরে অথবা বাহিরে কোথাও অমূর্ত ফোয়ারা নিত্যকাল