পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ২৩৭ আমার অদৃত দূতীটিকে যদিও চক্ষে দেখিতে পাই নাই, তথাপি তাহার মূর্তি আমার মনের অগোচর ছিল না। আরব রমণী, ঝোলা আস্তিনের ভিতর দিয়া শ্বেতপ্রস্তররচিতবৎ কঠিন নিটোল হস্ত দেখা যাইতেছে, টুপির প্রাস্ত হইতে মুখের উপরে একটি স্বহ্ম বসনের আবরণ পড়িয়াছে, কটিবন্ধে একটি বাক ছুরি বাধা । আমার মনে হইল, আরব্য উপন্যাসের একাধিক সহস্র রজনীর একটি রজনী আজ উপন্যাসলোক হইতে উড়িয়া আসিয়াছে । আমি যেন অন্ধকার নিশীথে সুপ্তিমগ্ন বোগদাদের নির্বাপিতদীপ সংকীর্ণ পথে কোনো এক সংকটসংকুল অভিসারে যাত্র করিয়াছি । অবশেষে আমার দূতী একটি ঘননীল পর্দার সম্মুখে সহসা থমকিয়া দাড়াইয়া যেন নিম্নে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইল । নিম্নে কিছুই ছিল না, কিন্তু ভয়ে আমার বক্ষের রক্ত স্তম্ভিত হইয়া গেল। আমি অনুভব করিলাম, সেই পর্দার সম্মুখে ভূমিতলে কিংখাবের-সাজ-পরা একটি ভীষণ কাফ্রি খোজ কোলের উপর খোলা তলোয়ার লইয়া দুই পা ছড়াইয়া দিয়া বসিয়া ঢুলিতেছে। দূত লঘুগতিতে তাহার দুই পা ডিঙাইয়া পর্দার এক প্রাস্তদেশ তুলিয়া ধরিল। ভিতর হইতে একটি পারস্য-গালিচা-পাত ঘরের কিয়দংশ দেখা গেল । তক্তের উপরে কে বসিয়া আছে দেখা গেল না— কেবল জাফরান রঙের স্ফীত পায়জামার নিম্নভাগে জরির-চট-পরা দুইখানি ক্ষুদ্র সুন্দর চরণ গোলাপি মখমল-আসনের উপর অলসভাবে স্থাপিত রহিয়াছে দেখিতে পাইলাম। মেজের এক পাশ্বে একটি নীলাভ স্ফটিকপাত্রে কতকগুলি আপেল নাশপাতি নারাঙ্গি এবং প্রচুর আজুরে গুচ্ছ সজ্জিত রহিয়াছে এবং তাহার পাশ্বে দুইটি ছোটো পেয়ালা ও একটি স্বর্ণাভ মদিরার কাচপাত্র অতিথির জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে। ঘরের ভিতর হইতে একটা অপূর্ব ধূপের একপ্রকার মাদক মুগন্ধি ধূম আসিয়া আমাকে বিহবল করিয়া দিল । আমি কম্পিতবক্ষে সেই খোজার প্রসারিত পদদ্বয় যেমন লঙ্ঘন করিতে গেলাম অমনি সে চমকিয়া জাগিয়া উঠিল— তাহার কোলের উপর হইতে তলোয়ার পাথরের মেজেয় শব্দ করিয়া পড়িয়া গেল । সহসা একটা বিকট চীংকার শুনিয়া চমকিয়া দেখিলাম, আমার সেই ক্যাম্পখাটের উপরে ঘর্মাক্তকলেবরে বসিয়া আছি, ভোরের আলোয় কৃষ্ণপক্ষের খণ্ড-চাদ জাগরণক্লিষ্ট রোগীর মতো পাণ্ডুবৰ্ণ হইয়া গেছে—এবং আমাদের পাগলা মেহের আলি তাহার প্রাত্যহিক প্রথা-অনুসারে প্রত্যুষের জনশূন্য পথে “তফাত যাও” “তফাত যাও” করিয়া চীৎকার করিতে করিতে চলিয়াছে।