পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ Հ8Գ নৌকাযোগে ছোটাে ছোটাে নদী-উপনদী দিয়া এক মেলা অন্তে অন্য মেলায় ঘুরিয়া বেড়ায় । গত বৎসর হইতে কলিকাতার এক ক্ষুদ্র জিম্ন্তাস্টিকের দল এই পর্যটনশীল মেলার আমোদচক্রের মধ্যে যোগ দিয়াছিল । তারাপদ প্রথমত নৌকারোহী দোকানির সহিত মিশিয়া মেলায় পানের থিলি বিক্রয়ের ভার লইয়াছিল। পরে তাহার স্বাভাবিক কৌতুহলবশত এই জিম্ন্যাস্টিকের ছেলেদের আশ্চর্য ব্যায়ামনৈপুণ্যে আকৃষ্ট হইয়া এই দলে প্রবেশ করিয়াছিল । তারাপদ নিজে নিজে অভ্যাস করিয়া ভালো বাশি বাজাইতে শিখিয়াছিল— জিম্ন্যাস্টিকের সময় তাহাকে দ্রুত তালে লক্ষে ষ্টুংরির স্বরে বাশি বাজাইতে হইত— এই তাহার একমাত্র কাজ ছিল । এই দল হইতেই তাহার শেষ পলায়ন। সে শুনিয়াছিল, নন্দীগ্রামের জমিদারবাবুরা মহাসমারোহে এক শখের যাত্রা খুলিতেছেন— শুনিয়া সে তাহার ক্ষুদ্র বোচকাটি লইয়া নন্দীগ্রামে যাত্রার আয়োজন করিতেছিল, এমন সময় মতিবাবুর সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয় । তারাপদ পর্ষায়ক্রমে নানা দলের মধ্যে ভিড়িয়াও আপন স্বাভাবিক কল্পনাপ্রবণ প্রকৃতিপ্রভাবে কোনো দলের বিশেষত্ব প্রাপ্ত হয় নাই। অস্তরের মধ্যে সে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত এবং মুক্ত ছিল। সংসারে অনেক কুংসিত কথা সে সর্বদা শুনিয়াছে এবং অনেক কদৰ্য দৃপ্ত তাহার দৃষ্টিগোচর হইয়াছে, কিন্তু তাহা তাহার মনের মধ্যে সঞ্চিত হইবার তিলমাত্র অবসর প্রাপ্ত হয় নাই। এ ছেলেটির কিছুতেই খেয়াল ছিল না। অন্যান্য বন্ধনের ন্যায় কোনোপ্রকার অভ্যাসবন্ধনও তাহার মনকে বাধ্য করিতে পারে নাই, সে এই সংসারের পঙ্কিল জলের উপর দিয়া শুভ্রপক্ষ রাজহংসের মতো সাতার দিয়া বেড়াইত। কৌতুহলবশত যতবারই ডুব দিত তাহার পাখা সিক্ত বা মলিন হইতে পারিত না। এইজন্য এই গৃহত্যাগী ছেলেটির মুখে একটি শুভ্র স্বাভাবিক তারুণ্য অম্লানভাবে প্রকাশ পাইত, তাহার সেই মুখশ্ৰী দেখিয়া প্রবীণ বিষয়ী মতিলালবাবু তাহাকে বিনা প্রশ্নে বিনা সন্দেহে পরম অাদরে আহবান করিয়া লইয়াছিলেন । দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ আহারান্তে নৌকা ছাড়িয়া দিল । অন্নপূর্ণ পরম স্নেহে এই ব্রাহ্মণবালককে তাহার ঘরের কথা, তাহার আত্মীয়পরিজনের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন ; তারাপদ অত্যন্ত সংক্ষেপে তাহার উত্তর দিয়া বাহিরে আসিয়া পরিত্রাণ লাভ করিল। বাহিরে বর্ষার নদী পরিপূর্ণতার শেষ রেখা পর্যন্ত ভরিয়া উঠিম| আপন আত্মহারা উদাম চাঞ্চল্যে প্রকৃতিমাতাকে যেন উদবিগ্ন করিয়া তুলিয়াছিল। মেঘনিমুক্ত