পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি २११ বাড়ি। কিন্তু ঘরে আসবাব অতি সামান্য, পারিপাট্যের কোনো লক্ষণ নেই ; নিষ্কাপেট মেঝের এক কোণে যেমন-তেমন একখানা টেবিল ; সবসুদ্ধ, পিতৃবিয়োগে ধোবা-নাপিতবর্জিত অশৌচদশার মতো শয্যাসনগুপ্ত ভাব, যেন বাইরের লোকের কাছে সামাজিকত রক্ষার কোনো দায় নেই। আমার বাসায় আহারাদির যে ব্যবস্থা তা গ্র্যান্ড, হোটেল নামধারী পান্থাবাসের পক্ষে নিতান্তই অসংগত। কিন্তু এজন্তে কোনো কুষ্ঠা নেই, কেননা সকলেরই এক দশা । - আমাদের বাল্যকালের কথা মনে পড়ে। তখনকার জীবনযাত্রা ও তার আয়োজন এখনকার তুলনায় কতই অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু সেজন্তে আমাদের কারো মনে কিছুমাত্র সংকোচ ছিল না। তার কারণ, তখনকার সংসারযাত্রার আদর্শে অত্যন্ত বেশি উচুনিচু ছিল না। সকলেরই ঘরে একটা মোটামুটি রকমের চালচলন ছিল ; তফাত যা ছিল তা বৈদগ্ধোর, অর্থাৎ গানবাজনা পড়াশুনো ইত্যাদি নিয়ে । তা ছাড়া ছিল কৌলিক রীতির পার্থক্য, অর্থাৎ ভাষাভাবভঙ্গী আচারবিচার -গত বিশেষত্ব। কিন্তু তখন আমাদের আহারবিহার ও সকল -প্রকার উপকরণ যা ছিল তা দেখলে এখনকার মধ্যবিত্ত লোকদের মনেও অবজ্ঞা জাগতে পারত। ধনগত বৈষম্যের বড়াই আমাদের দেশে এসেছে পশ্চিম মহাদেশ থেকে। এক সময়ে আমাদের দেশে যখন হাল আমলের আপিসবিহারী ও ব্যাবসাদারদের ঘরে নতুন টাকার আমদানি হল তখন তারা বিলিতি বাবুগিরির চলন শুরু করে দিলে। তখন থেকে আসবাবের মাপেই ভদ্রতার পরিমাপ আরম্ভ হয়েছে। তাই আমাদের দেশেও আজকাল কুলশীল রীতিনীতি বুদ্ধিবিদ্যা সমস্ত ছাপিয়ে চোখে পড়ে ধনের বিশিষ্টতা। এই বিশিষ্টতার গৌরবই মানুষের পক্ষে সব চেয়ে অগৌরব । এরই ইতরতা যাতে মজ্জার মধ্যে প্রবেশ না করে সেজন্তে বিশেষ সাবধান হওয়া উচিত। এখানে এসে সব চেয়ে যেটা আমার চোখে ভালো লেগেছে সে হচ্ছে, এই ধনগরিমার ইতরতার সম্পূর্ণ তিরোভাব। কেবলমাত্র এই কারণেই এ দেশে জনসাধারণের আত্মমর্যাদা এক মুহূর্তে অবারিত হয়েছে। চাষাভুষো সকলেই আজ অসম্মানের বোঝা ঝেড়ে ফেলে মাথা তুলে দাড়াতে পেরেছে, এইটে দেখে আমি যেমন বিস্মিত তেমনি আনন্দিত হয়েছি। মাহুষে মানুষে ব্যবহার কী আশ্চর্য সহজ হয়ে গেছে। অনেক কথা বলবার আছে, বলবার চেষ্টা করব ; কিন্তু এই মুহূর্তে আপাতত বিশ্রাম করবার দরকার হয়েছে। অতএব জানলার সামনে লম্বা কেদারার উপর হেলান দিয়ে বসব, পায়ের উপর একটা কম্বল টেনে দেব— তার পরে চোখ যদি বুজে আসতে চায় জোর করে টেনে রাখতে চেষ্টা করব না । ইতি ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৩•