পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

HI8 রবীন্দ্র-রচনাবলী মার খেতে খেতেও মরতে চায় না । আমাদের স্বদেশী রাজা বা জমিদারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা আরো অনেক কম। ইংলণ্ডে থাকার সময় এট লক্ষ্য করে দেখেছি, ভারতবর্ষে দগুবিধানব্যাপারে গ্লানিজনক ঘটনা ইংরেজ খবরের কাগজে প্রায় কিছুই এসে পৌছত না । তার একমাত্র কারণ এ নয়, পাছে যুরোপে বা আমেরিকায় নিন্দ রটে। বস্তুত, কড়া ইংরেজ শাসনকর্তা স্বজাতির শুভবুদ্ধিকেই ভয় করে। বেশ করেছি, খুব করেছি, দরকার ছিল জবরদস্তি করবার— এটা বুক ফুলিয়ে বলা ইংরেজদের পক্ষে সহজ নয়, তার কারণ ইংরেজের মধ্যে বড়ো মন আছে। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে আসল কথাগুলো ইংরেজ খুব কম জানে। নিজেদের উপর ধিক্কার দেবার কারণ চাপা থাকে। এ কথাও সত্য, ভারতের নিমক দীর্ঘকাল যে খেয়েছে তার ইংরেজি যকৃৎ এবং হৃদয় কলুষিত হয়ে গেছে, অথচ আমাদের ভাগ্যক্রমে তারাই হল অথরিটি । ভারতবর্ষে বর্তমান বিপ্লব উপলক্ষে দগুচালনা সম্বন্ধে কর্তৃপক্ষ বলেছেন যে, তার পীড়ন ছিল নূ্যনতম মাত্রায়। এ কথা মেনে নিতে আমরা অনিচ্ছুক, কিন্তু অতীত ও বর্তমানের প্রচলিত শাসননীতির সঙ্গে তুলনা করে দেখলে কথাটাকে অত্যুক্তি বলতে পারব না। মার খেয়েছি, অন্যায় মারও যথেষ্ট খেয়েছি ; এবং সব চেয়ে কলঙ্কের কথা গুপ্ত মার, তারও অভাব ছিল না । এ কথাও বলব, অনেক স্থলেই যারা মার খেয়েছে মাহাত্ম্য তাদেরই, যারা মেরেছে তারা আপন মান খুইয়েছে। কিন্তু সাধারণ রাষ্ট্রশাসন নীতির আদর্শে আমাদের মারের মাত্রা নূনতম বইকি। বিশেষত আমাদের পরে ওদের নাড়ীর টান নেই, তা ছাড়া সমস্ত ভারতবর্ষকে জালিয়ান ওআলাবাগ করে তোলা এদের পক্ষে বাহুবলের দিক থেকে অসম্ভব ছিল না। আমেরিকার সমগ্র নিগ্রেজাতি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নিজেদের যোগ বিচ্ছিন্ন করবার জন্যে যদি স্পর্ধাপূর্বক অধ্যবসায়ে প্রবৃত্ত হত তা হলে কিরকম বীভৎসভাবে রক্তপ্লাবন ঘটত, বর্তমান শাস্তির অবস্থাতেও তা অনুমান করে নিতে অধিক কল্পনাশক্তির প্রয়োজন হয় না। তা ছাড়া ইটালি প্রভৃতি দেশে যা ঘটেছে তা নিয়ে আলোচনা করা বাহুল্য। কিন্তু এতে সাত্বনা পাই নে। যে মার লাঠির ডগায় সে মার দুদিন পরে ক্লাস্ত হয়ে পড়ে, এমন-কি, ক্রমে তার লজ্জা আসাও অসম্ভব নয়। কিন্তু যে মার অন্তরে অন্তরে সে তো কেবল কতকগুলো মামুষের মাথা ভেঙে তার পরে খেলাঘরের ব্রিজ-পার্টির অন্তরালে অন্তর্ধান করে না। সমস্ত জাতকে সে যে ভিতরে ভিতরে ফতুর করে দিলে। শতাব্দীর পর শতাব্দী তার তো বিরাম নেই। ক্রোধের মার থামে, লোভের মারের অন্ত পাওয়া যায় না ।