পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৬২ রবীন্দ্র-রচনাবলী অংশে অনেকখানি জল ছিল । জলের অংশ ছিল নীচে, তেলের অংশ ছিল উপরে । আলো মিট্‌মিটু করে জলত, অনেকখানি ছড়াত ধোঁয়া। এটা কতকটা আমাদের সাবেক কালের অবস্থা। ভদ্রসাধারণ এবং ইতরসাধারণের সম্বন্ধটা এইরকমই ছিল। তাদের মর্যাদা সমান নয় কিন্তু তবুও তারা উভয়ে একত্র মিলে একই আলো জালিয়ে রেখেছিল। তাদের ছিল একটা অখণ্ড আধার। আজকের দিনে তেল গিয়েছে এক দিকে, জল গিয়েছে আর-এক দিকে ; তেলের দিকে আলোর উপাদান অতি সামান্য, জলের দিকে একেবারেই নেই। বয়স যখন হল, ঘরে এল কেরোসিনের ল্যাম্প বিদেশ থেকে ; তাতে সবটাতেই এক তেল, সেই তেলের সমস্তটার মধ্যেই উদ্দীপনের শক্তি । আলোর উজ্জলতাও বেশি। এর সঙ্গে যুরোপীয় সভ্যসমাজের তুলনা করা যেতে পারে। সেখানে এক জাতেরই বিদ্যা ও শক্তি দেশের সকল লোকের মধ্যেই ব্যাপ্ত। সেখানে উপরিতল নিম্নতল আছে, সেই উপরিতলের কাছেই বাতি দীপ্ত হয়ে জলে, নীচের তল অদীপ্ত । কিন্তু, সেই ভেদ অনেকটা আকস্মিক ; সমস্ত তেলের মধ্যেই দীপ্তির শক্তি আছে। সে হিসাবে জ্যোতির জাতিভেদ নেই ; নীচের তেল যদি উপরে ওঠে তা হলে উজ্জলতার তারতম্য ঘটে না । সেখানে নীচের দলের পক্ষে উপরের দলে উত্তীর্ণ হওয়া অসাধ্য নয় ; সেই চেষ্টা নিয়তই চলছে। আর-এক শ্রেণীর বাতি আছে তাকে বলি বিজলি বাতি। তার মধ্যে তারের কুণ্ডলী আলো দেয়, তার আগাগোড়াই সমান প্রদীপ্ত। তার মধ্যে দীপ্ত-অদীপ্তের ভেদ নেই ; এই আলো দিবালোকের প্রায় সমান। যুরোপীয় সমাজে এই বাতি জালাবার উদ্যোগ সব দেশে এখন চলছে না ; কিন্তু কোথাও কোথাও শুরু হয়েছে— এর যন্ত্রটাকে পাক৷ করে তুলতে হয়তো এখনো অনেক ভাঙচুর করতে হবে, যন্ত্রের মহাজন কেউ কেউ হয়তো দেউলে হয়ে যেতেও পারে, কিন্তু পশ্চিম মহাদেশে এই দিকে একটা ঝোক পড়েছে সে কথা আর গোপন করে রাখবার জো নেই। এইটে হচ্ছে প্রকাশের চেষ্টা, মানুষের অন্তর্নিহিত ধর্ম; এই ধর্মসাধনায় সকল মানুষই অব্যাহত অধিকার লাভ করবে এইরকমের একটা প্রয়াস ক্রমশই যেন ছড়িয়ে পড়ছে। কেবল আমাদের হতভাগ্য দেশে দেখি, মাটির প্রদীপে যে আলো একদিন এখানে জলেছিল তাতেও আজ বাধা পড়ল। আজ আমাদের দেশের ডিগ্রিধারীরা পল্লীর কথা যখন ভাবেন তখন তাদের জন্তে অতি সামান্ত ওজনে কিছু করাকেই যথেষ্ট বলে মনে করেন। যতক্ষণ আমাদের এইরকমের মনোভাব ততক্ষণ পল্লীর লোকেরা আমাদের পক্ষে বিদেশী । এমন-কি, তার চেয়েও তারা বেশি পর, তার কারণ এই— আমরা স্কুলে