পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী صbه 8 প্রজ্ঞানেনেনমাপুরাং– যুক্তিতর্কের যোগে বাহজানের বিষয়কে যেমন করে জানি এ তো তেমন করে জানা নয়, অন্তরে হওয়ার দ্বারা জানা । নদী সমুদ্রকে পায় যেমন করে, প্রতিক্ষণেই সমুদ্র হতে হতে। এক দিকে সে ছোটো নদী, আর-এক দিকে সে বৃহৎ সমুদ্র । সেই হওয়া তার পক্ষে সম্ভব, কেননা সমুদ্রের সঙ্গে তার স্বাভাবিক ঐক্য ; বিচ্ছেদের ভিতর দিয়ে সেই ঐক্য। জীবধর্ম যেন উচু পাড়ির মতে জন্তুদের চেতনাকে ঘিরে আটক করেছে। মানুষের আত্মা জীবধর্মের পাড়ির ভিতর দিয়ে তাকে কেবলই পেরিয়ে চলেছে, মিলেছে আত্মার মহাসাগরে, সেই সাগরের যোগে সে জেনেছে আপনাকে । যেমন নদী পায় আপনাকে যখন সে বৃহৎ জলরাশিকে আপন করে ; নইলে সে থাকে বদ্ধ হয়ে, বিল হয়ে, জলা হয়ে । তাই বাউল মানুষকে বলেছে, “তোরই ভিতর অতল সাগর।” পূর্বেই বলেছি ; মানুষ আপন ব্যক্তিগত সংস্কারকে পার হয়ে যে জ্ঞানকে পায়, যাকে বলে বিজ্ঞান, সেই জ্ঞান নিখিল মানবের, তাকে সকল মানুষই স্বীকার করবে, সেইজন্যে তা শ্রদ্ধেয় । তেমনি মানুষের মধ্যে স্বার্থগত আমির চেয়ে যে বড়ো আমি সেই-আমির সঙ্গে সকলের ঐক্য, তার কর্ম সকলের কর্ম। একলা আমির কর্মই বন্ধন, সকল আমির কর্ম মুক্তি। আমাদের বাংলাদেশের বাউল বলেছে— মনের মানুষ মনের মাঝে করো অন্বেষণ । একবার দিব্যচক্ষু খুলে গেলে দেখতে পাবি সর্বঠাই । সেই মনের মহিষ সকল মনের মানুষ, আপন মনের মধ্যে তাকে দেখতে পেলে সকলের মধ্যেই তাকে পাওয়া হয়। এই কথাই উপনিষদ বলেছেন, যুক্তাত্মান: সর্বমেবাবিশস্তি । বলেছেন, তং বেদ্যং পুরুষং বেদ— যিনি বেদনীয় সেই পূর্ণ মানুষকে জানো ; অস্তরে আপনার বেদনায় র্যাকে জানা যায় তাকে সেই বেদনায় জানো, জ্ঞানে নয়, বাইরে নয়। আমাদের শাস্ত্রে সোহহম্ বলে যে তত্ত্বকে স্বীকার করা হয়েছে তা যত বড়ে অহংকারের মতো শুনতে হয় আসলে তা নয়। এতে ছোটোকে বড়ো বলা হয় নি, এতে সত্যকে ব্যাপক বলা হয়েছে । আমার যে ব্যক্তিগত আমি তাকে ব্যাপ্ত করে আছে বিশ্বগত আমি। মাথায় জটা ধারণ করলে, গায়ে ছাই মাখলে, বা মুখে এই শব্দ উচ্চারণ করলেই সোহহম-সত্যকে প্রকাশ করা হল, এমন কথা যে মনে করে সেই অহংকৃত। যে আমি সকলের সেই আমিই আমারও এটা সত্য, কিন্তু এই সত্যকে আপন করাই মানুষের সাধনা । মামুষের ইতিহাসে চিরকাল এই সাধনাই নানা রূপে নানা নামে নানা সংকল্পের মধ্য দিয়ে চলেছে। যিনি পরম আমি, যিনি সকলের আমি, সেই আমিকেই আমার বলে সকলের মধ্যে জানা যে পরিমাণে আমাদের জীবনে,