পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম 8 ა©) এই স্বশ্ববাস্থলোক ভূলোকের একান্ত আপনারই বলে সম্ভব হয়েছে পৃথিবীর ধূলিস্তরে এত বিচিত্ৰ ঐশ্বৰ্ষবিস্তার যার মূল্য ধূলির মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। উপনিষদ বলেন, অসম্ভৃতি ও সস্তৃতিকে এক করে জানলেই তবে সত্য জানা হয়। অসম্ভৃত্তি যা অসীমে অব্যক্ত, সস্তৃতি যা দেশে কালে অভিব্যক্ত। এই সীমায় অসীমে মিলে মানুষের সত্য সম্পূর্ণ। মানুষের মধ্যে যিনি অসীম তাকে সীমার মধ্যে জীবনে সমাজে ব্যক্ত করে তুলতে হবে । অসীম সত্যকে বাস্তব সত্য করতে হবে। তা করতে গেলে কর্ম চাই। ঈশোপনিষদ তাই বলেন, “শত বৎসর তোমাকে বাচতে হবে, কর্ম তোমার না করলে নয়।” শত বৎসর বঁাচাকে সার্থক করো কর্মে— এমনতরো কর্মে যাতে প্রত্যয়ের সঙ্গে, প্রমাণের সঙ্গে, বলতে পারা যায় লোহহম্। এ নয় যে, চোখ উলটিয়ে, নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হবে মানুষের থেকে দূরে। অসীম উদ্ভূত্ত থেকে মানুষের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠতা সঞ্চারিত হচ্ছে সে কেবল সত্যং ঋতং নয়, তার সঙ্গে আছে রাষ্ট্রং শ্রমে ধর্মশ্চ কর্ম চ ভূতং ভবিষ্যৎ । এই-যে কর্ম, এই-যে শ্রম, যা জীবিকার জন্তে নয়, এর নিরস্তর উদ্যম কোন সত্যে। কিসের জোরে মানুষ প্রাণকে করছে তুচ্ছ, দুঃখকে করছে বরণ, অন্যায়ের দুর্দান্ত প্রতাপকে উপেক্ষা করছে বিনা উপকরণে, বুক পেতে নিচ্ছে অবিচারের দুঃসহ মৃত্যুশেল। তার কারণ, মানুষের মধ্যে শুধু কেবল তার প্রাণ নেই, আছে তার মহিমা। সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষেরই মাথা তুলে বলবার অধিকার আছে, সোহহম্। সেই অধিকার জাতিবর্ণনির্বিচারে সকল মানুষেরই। ক্ষিতিমোহনের অমূল্য সংগ্রহ থেকে বাউলের এই বাণী পাই— জীবে জীবে চাইয়া দেখি সবই যে তার অবতার, ও তুই নূতন লীলা কী দেখাবি যার নিত্যলীলা চমৎকার। প্রতিদিনই মানব-সমাজে এই লীলা । অসংখ্য মানুষ জ্ঞানে প্রেমে ত্যাগে নানা আকারেই অপরিমেয়কে প্রকাশ করছে। ইতিহাসে তাদের নাম ওঠে না, আপন প্রাণ থেকে মামুষের প্রাণপ্রবাহে তারা ঢেলে দিয়ে যায় তারই অমিততেজ যশ্চায়মস্মিন তেজোময়োহমৃতময়ঃ পুরুষঃ সৰ্বাহভূঃ– যিনি এই আত্মার মধ্যেই তেজোময় অমৃতময় পুরুষ, যিনি সমস্তই অনুভব করেন, যেমন আকাশব্যাপী তেজকে উদ্ভিদ আপন প্রাণের সামগ্রী করে নিয়ে পৃথিবীর প্রাণলোকে উৎসর্গ করে। উদ্ভিদের ভিতর দিয়ে বিশ্বতেজ যদি প্রাণবস্তুতে নিয়ত পরিণত না হতে পারত তা হলে জীবলোক যেমন মরুশয্যাশায়ী হত, তেমনি আমাদের গোচরে-অগোচরে দেশে দেশে কালে-কালে নরনারী নিজের অন্তরস্থিত পরমপুরুষের অমিততেজ যদি কল্যাণে ও প্রেমে, জ্ঞানে ও কর্মে, নিরস্তর সমাজের প্রাণবস্তুতে পরিণত না করত, তা হলে সমাজ