পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম 8&S2 ইস্কুল ছিল। রাস্তাটা পেরিয়েই ইস্কুলের হাতাটা দেখা যেত। সে দিকে চেয়ে দেখলুম, গাছের আড়ালে স্বর্য উঠছে। যেমনি স্বর্ষের আবির্ভাব হল গাছের অন্তরালের থেকে, অমনি মনের পর্দা খুলে গেল। মনে হল, মানুষ আজন্ম একটা আবরণ নিয়ে থাকে। সেটাতেই তার স্বাতন্ত্র্য। স্বাতন্ত্র্যের বেড়া লুপ্ত হলে সাংসারিক প্রয়োজনের অনেক অসুবিধা। কিন্তু, সেদিন স্থৰ্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার আবরণ খসে পড়ল। মনে হল, সত্যকে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখলুম। মানুষের অন্তরাত্মাকে দেখলুম। দুজন মুটে কাধে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে চলেছে। তাদের দেখে মনে হল, কী অনির্বচনীয় স্বন্দর। মনে হল না, তারা মুটে । সেদিন তাদের অন্তরাত্মাকে দেখলুম, যেখানে আছে চিরকালের মানুষ । o k সুন্দর কাকে বলি। বাইরে যা অকিঞ্চিৎকর, যপন দেখি তার আন্তরিক অর্থ তখন দেখি স্বন্দরকে। একটি গোলাপফুল বাছুরের কাছে স্বন্দর নয়। মানুষের কাছে সে সুন্দর— যে মানুষ তার কেবল পাপড়ি না, বোটা না, একটা সমগ্র আস্তরিক সার্থকতা পেয়েছে। পাবনার গ্রামবাসী কবি যখন প্রতিকুল প্রণয়িনীর মানভঞ্জনের জন্যে ট্যাহ দামের মোটরি” আনার প্রস্তাব করেন তখন মোটরির দাম এক টাকার চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। এই মোটরি বা গোলাপের আস্তরিক অর্থটি যখন দেখতে পাই তখনই সে সুন্দর। সেদিন তাই আশ্চর্য হয়ে গেলুম। দেখলুম, সমস্ত স্বষ্টি অপরূপ। আমার এক বন্ধু ছিল, সে স্ববুদ্ধির জন্যে বিশেষ বিখ্যাত ছিল না। তার স্ববুদ্ধির একটু পরিচয় দিই। একদিন সে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, "আচ্ছা, ঈশ্বরকে দেখেছ?” আমি বললুম, “না, দেখি নি তো ।” সে বললে, “আমি দেখেছি।” জিজ্ঞাসা করলুম, “কিরকম।” সে উত্তর করলে, “কেন ? এই-যে চোখের কাছে বিজ, বিজ, করছে।” সে এলে ভাবতুম, বিরক্ত করতে এসেছে। সেদিন তাকেও ভালো লাগল। তাকে নিজেই ডাকলুম। সেদিন মনে হল, তার নির্বুদ্ধিতাটা আকস্মিক, সেটা তার চরম ও চিরন্তন সত্য নয়। তাকে ডেকে সেদিন আনন্দ পেলুম। সেদিন সে ‘অমুক' নয়। আমি যার অন্তর্গত সেও সেই মানবলোকের অন্তর্গত। তখন মনে হল, এই মুক্তি। এই অবস্থায় চার দিন ছিলুম। চার দিন জগংকে সত্যভাবে দেখেছি। তার পর জ্যোতিদা বললেন, “দাৰ্জিলিঙ চলো।” সেখানে গিয়ে আবার পর্দা পড়ে গেল। আবার সেই অকিঞ্চিৎকরত, সেই প্রাত্যহিকতা। কিন্তু, তার পূর্বে কয়দিন সকলের মাঝে র্যাকে দেখা গেল তার সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত আর সংশয় রইল না। তিনি সেই অখণ্ড মানুষ যিনি মানুষের ভূত-ভবিষ্যতের মধ্যে পরিব্যাপ্ত— যিনি অরূপ, কিন্তু সকল মানুষের রূপের মধ্যে র্যার অন্তরতম আবির্ভাব । ' ' . . .