পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

●ፃ8 - রবীন্দ্র-রচনাবলী এদের চেহারার একটা বিশেষত্ব আছে । এদের মনের গড়নটাও কিছু বিশেষ ধরণের । এই বিশেষত্বের লক্ষণ অনুসারে দলের লোক পরস্পরকে বিশেষ আত্মীয় বলে অহুভব করে। মানুষ আপনাকে সত্য বলে পায় এই আত্মীয়তার স্বত্রে গাথা বহুদূরব্যাপী বৃহৎ ঐক্যজালে । মানুষকে মানুষ করে তোলবার ভার এই জাতিক সত্তার উপরে। সেইজন্যে মামুষের সবচেয়ে বড়ো আত্মরক্ষা এই জাতিক সত্তাকে রক্ষণ করা । এই তার বৃহৎ দেহ, তার বৃহৎ আত্ম। এই আত্মিক ঐক্যবোধ যাদের মধ্যে দুর্বল, সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠবার শক্তি তাদের ক্ষীণ । জাতির নিবিড় সম্মিলিত শক্তি তাদের পোষণ করে না, রক্ষণ করে না। তারা পরস্পর বিশ্লিষ্ট হয়ে থাকে, এই বিশ্লিষ্টতা মানবধর্মের বিরোধী । বিশ্লিষ্ট মানুষ পদে পদে পরাভূত হয়, কেননা তারা সম্পূর্ণ মাহুষ নয়। যেহেতু মানুষ সম্মিলিত জীব এইজন্যে শিশুকাল থেকে মানুষের সবচেয়ে প্রধান শিক্ষা— পরস্পর মেলবার পথে চলবার সাধনা | ধেখানে তার মধ্যে জন্তুর ধর্ম প্রবল সেখানে স্বেচ্ছা এবং স্বার্থের টানে তাকে স্বতন্ত্র করে, ভালোমত মিলতে দেয় বাধা ; তখন সমষ্টির মধ্যে যে ইচ্ছা, যে শিক্ষণ, যে প্রবর্তন দীর্ঘকাল ধরে জমে আছে সে জোর ক’রে বলে, “তোমাকে মানুষ হতে হবে কষ্ট ক’রে ; তোমার জন্তুধর্মের উণ্টে পথে গিয়ে ’ জাতিক সভার অন্তর্গত প্রত্যেকের মধ্যে নিয়ত এই ক্রিয়া চলছে ব’লে একটা বৃহৎ সীমানার মধ্যে একটা বিশেষ ছাদের মহন্তসংঘ তৈরি হয়ে উঠছে । একটা বিশেষ জাতিক নামের ঐক্যে তারা পরস্পর পরস্পরকে চেনে, তারা পরস্পরের কাছ থেকে বিশেষ অবস্থায় বিশেষ আচরণ নিশ্চিন্ত মনে প্রতাশ করতে পারে । মানুষ জন্মায় জন্তু হয়ে, কিন্তু এই সংঘবদ্ধ ব্যবস্থার মধ্যে অনেক দুঃখ করে সে মানুষ হয়ে ওঠে । এই-যে বহুকালক্ৰমাগত ব্যবস্থা যাকে আমরা সমাজ নাম দিয়ে থাকি, যা মহন্তত্বের প্রেরস্থিত, তাকেও স্বষ্টি করে চলেছে মানুষ প্রতিনিয়ত— প্রাণ দিয়ে, ত্যাগ দিয়ে, চিস্তা দিয়ে, নব নব অভিজ্ঞতা দিয়ে, কালে কালে তার সংস্কার ক’রে । এই অবিশ্রাম দেওয়ানেওয়ার দ্বারাই সে প্রাণবান হয়ে ওঠে, নইলে সে জড়যন্ত্র হয়ে থাকত এবং তার দ্বারা পালিত এবং চালিত মানুষ হত কলের পুতুলের মতো ; সেষ্ট-সব যান্ত্রিক নিয়মে বাধা মানুষের মধ্যে নতুন উদ্ভাবনা থাকত না, তাদের মধ্যে অগ্রসরগতি হত অবরুদ্ধ । সমাজ এবং সমাজের লোকদের মধ্যে এই প্ৰাণগত মনোগত মিলনের ও আদানপ্রদানের উপায়স্বরূপে মানুষের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ যে স্থাই সে হচ্ছে তার ভাষা । এই ভাষার নিরস্তর ক্রিয়ায় সমস্ত জাতকে এক করে তুলেছে , নইলে মাছুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে মানবধর্ম থেকে বঞ্চিত হত ।